দেলওয়ার হোসেন
প্রিন্ট
বুধবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪
সর্বশেষ আপডেট : ১০:০১ পূর্বাহ্ণ
তখন বঙ্গবন্ধু এভিনিউ এবং পরে পুরানা পল্টনে আমাদের পত্রিকা অফিস আর দশটা পত্রিকা অফিসের মত প্রতিদিনই অগণিত নবীন- প্রবীন- প্রতিষ্ঠিত লেখক-সাংবাদিক, শিল্পী, কবি সাহিত্যিকদের আনাগোনা এবং সরব আড্ডায় সরগরম থাকতো । আশির দশকের শুরু মাত্র ।বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার পাশাপাশি সাংবাদিকতায় যুক্ত নবীন কলমজীবি । তাই এসাইনমেন্ট নিয়ে চেয়ার-টেবিলে মগ্ন কাজে কান খাড়া রেখে এসব আড্ডায় মৌণ শ্রোতার ভুমিকায় থাকতাম । তবুও প্রত্যেকের সাথে হার্দিক হৃদ্যতা , বন্ধুত্ব ও প্রাণবন্ত ভালোবাসার বন্ধনটা গড়ে উঠেছিল পোক্তভাবে ।যা এত বছর পেরিয়ে আজও মলিন হয়নি এতটুকু। সেই স্মৃতিবহুল কাব্য লিখতে গেলে বিশাল আকারের উপন্যাস হবে ।সেদিকে না যাই ।
লিখবো শুধু মাত্র স্বল্প কথায় – জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে কবি হেলাল হাফিজের যাপিত জীবনের মাত্র কয়েকটি বেদনাদায়ক দিনপঞ্জির কথা। ৮০ দশকের শেষের দিকে প্রবাস জীবন বেছে নেবার পর এই জগতের অনেকের সাথে নিবিড় যোগাযোগ থাকলেও হেলাল হাফিজের সাথে ছিল না । ২০২১ সালে মিডিয়ায় হেলাল হাফিজের অসুস্থতার খবর জানার পর তার সাথে টেলিফোনে নিবিড় সংযোগ প্রতিষ্ঠিত হলো আমার ।জানতে চেয়েছিলেন – এতবছর কোথায়, কেন এভাবে সংযোগ বিচ্ছিন্ন ছিলাম ।সেই সাথে নানান বিষয়ে জানতে চাওয়া অফুরন্ত কথা ।
এক পর্যায়ে থেমে গেলেন স্ত্রীর অসুস্থতার কথা শুনে ।মনে হলো প্রচন্ড ধাক্কা খেলেন ।কথার মাঝে দীর্ঘশ্বাস ছড়িয়ে হাজার প্রশ্ন – সমস্যা, সেবা-যত্ন ও চিকিৎসা নিয়ে ।আমরা দুজন এই বিষয়ের মধ্যেই আটকা পড়ে গেলাম ।এর বাইরে আর অন্য কোন প্রসংগের অবতারনার সুযোগ হলো না, হতোও না । টেলিফোনে নিয়মিতই কথা হতো।টেলিফোনে – কথা শুরু ও শেষ হতো এই একটি প্রসঙ্গেই , বৌমা কেমন আছে, তার শরীরটা কেমন যাচ্ছে ।তুমি একা কতটুকু সামলে নিতে পারছো ? তার প্রতি যেন কোন অবহেলা না হয় ।ডাক্তার কী বলছে ? কোন স্টেজ চলছে ? তুমি মোটেও ধৈর্য হারাবে না । বৌমার কষ্টের কথা আমি উপলব্ধি করতে পারি । তার কথা আমার প্রতিদিন মনে পড়ে ।
দেশে যাওয়ার প্রসংগ উঠতেই বলেন – তুমি এলে বৌমার কী হবে ।উনাকে কে টেক কেয়ার করবে । আশ্বস্ত হবার পর বার বার বলেছেন – দেশে এলে তুমি আমার এখানে উঠবে ।আমি এখানে শাহবাগে একটি হোটেলে থাকি । এখানে থাকা খাওয়ার ভালো ব্যবস্থা আছে ।এখানকার কর্মচারীরা বেশ ভালো ।আমাকে বেশ টেক কেয়ার করে ।তোমারও কোন অসুবিধা হবে না ।
কবিকে বলেছিলাম আপনার জীবনী নিয়ে একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নেবো ।বই বের করবো ।২০২১ সালে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা আমার প্রথম বইটি প্রকাশের পর, প্রকাশকের দেয়া টিপস অনুযায়ী কবির জীবনী নিয়ে লেখা এবং একটী ডকুমেন্টারি করার কথা ভেবেছিলাম। কবি বলেছিলেন – আমি তো অসুস্থ । একনাগাড়ে দীর্ঘক্ষণ কথা বলতে পারবো না ।এজন্য তোমাকে তো অনেকদিন থাকতে হবে আমার পাশে । তাহলে বৌমার কী হবে ?
২০২২ এ দেশে গেলাম ।বেশ অসুস্থ ছিলেন কবি ।চিকিৎসাধীন থাকার কারণে দেখা হলো না ।গতবছর ২০২৩ এ দেশে গিয়েও দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেখা হলো না কবির সাথে ।করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ফিরে এলাম সুইডেনে । ফিরে আসার পর টেলিফোনে যোগাযোগ হলো ।ভীষণ মনোকষ্ট নিয়ে বললেন – তোমার সাথে দেখাটা হলো না ।তবে তোমার জন্য প্রার্থনা করি – বৌমা এবং তোমাকে ভালো থাকতে হবে । তুমি অসুস্থ হলে বৌমার কী হবে ? আমি নির্বাক
আমাদের টেলিযোগাযোগটা ছিল অব্যহত ।বেশিরভাগ কথা হতো ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে । অনেক সময় সাড়া শব্দ না পেলে, পরবর্তী কল এ দুঃখ প্রকাশ করতেন ।বলতেন শরীরটা ভালো যাচ্ছে না ।ক্লান্তিতে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম । ঘুমটাও তো ঠিকভাবে আসে না । সময় কাটে না ।চোখের সমস্যা । পড়াশোনা ও লেখালেখিও ঠিকভাবে করতে পারছি না । একজন তরুন ভক্ত- শুভাকাংখীর কথা বলেছিলেন । ও মাঝে মাঝে আসে আমার কাছে । বেশ সময় দেয় । আমার অনেক কাজ করে দেয় ।কেউ পাশে থাকলে একটু ভালো লাগে ।এছাড়া ভালো থাকার মত তো আর কিছু নাই ।
আমি নির্বিকার চিত্তে কবির ভয়াবহ নির্জনতা, শূন্যতা, মরুপ্রান্তরের হাহাকার ধ্বনি ও মর্ম বেদনার কথা শুনি ।দিব্য দৃষ্টিতে দেখি নির্মম বেদনার কালিতে ঢাকা কবির চোখের অদৃশ্য অশ্রুজলের বন্ধ্যা ধারা ।আমার করার কিছুই থাকে না । আমি নির্বাক – স্থবির ।কখন যে আমার দু চোখ বেয়ে অশ্রু গড়াতে থাকে, বুঝি না ।কবির জন্য বেদনা গভীর হতে থাকে ।হৃদয়ের ভেতর ভাংচুর বেসামাল হয়ে উঠলে বিদায়ের আর্জি জানাতেই – বৌমার জন্য শুভকামনা জানাতে আর ভুল করেন না কবি ।বৌমাকে আমার শুভেচ্ছা দিও ।যেন এটা বলেও শেষ হয় না তার শেষ কথা ।
আবার কথা হলেও সেই একই কথা ।সন্ধ্যায় ফোন করে খাওয়ার কথা জানতে চাইলে বলেন – এখনও তো দুপুরের খাবারই খাইনি । কেন ? শরীরটা খারাপ যাচ্ছে ।বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছা হচ্ছিল না ক্ষুধাও তেমন একটা নেই । আর হোস্টেলের খাবার ভালো হলেও একই ধরনের খাবার নিয়মিত খেতে আর কত ভালো লাগে ? তবুও –এখন যাবো ভাবছি । হ্যাঁ তাই করেন বলে ফোন রাখতেই শেষ কথাটি ভেসে আসে – বৌমাকে শুভেচ্ছা দিও ।শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করে অসুস্থ অন্যজনের রোগমুক্তি কামনা করার পরম হার্দিক মানুষটি আজ নেই ।নিজে অসুস্থ থেকে বেদনা জর্জরিত শরীর মন দিয়ে অন্যের বেদনামুক্তির প্রার্থনা করে নিজের বেদনাকে ঢেকেছে্ন অদৃশ্য চোখের জলে – গোটা যৌবন ও বার্ধক্যকে একান্ত সঙ্গী করে ।যাপিত জীবনে একটি আজানুলম্বিত বেদনার কাব্য লিখে গেছেন অমর প্রেমের উপাখ্যানে । কবি তুমি ভালোবাসায় থেকো, স্মরনীয়-বরনীয় থেকো আমাদের ভালোবাসার বন্ধনে ।
স্টকহোল্ম, ১৭ ডিসেম্বর, ২০২৪
(লেখক সুইডেন প্রবাসী সাংবাদিক )
Posted ১০:০১ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪
nyvoice24 | New York Voice 24