
প্রদীপ মালাকার- নিউইয়রক,ইউ,এস,এ
প্রিন্ট
রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪
সর্বশেষ আপডেট : ৫:৪১ পূর্বাহ্ণ
প্রথমেই ইসকন নিয়ে কিছুকটা আলোচনা করা যাক । এই মুহূর্তে দেশে এবং দেশের বাহিরে ইস কন ও বাংলাদেশ শাখার প্রধান গ্রেপ্তারকৃত চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে নিয়ে বিশ্ব মিডিয়ায় চর্চা হচ্ছে । ইস্কন একটি ধর্মীয় ও সামাজিক সংগঠন । ৫০ পূর্বে ১৯৬৬ সালে আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে ইসকনের প্রতিষ্ঠা । সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ । ইস্কন মুলত বৈষ্ণব ধর্মের একটি অংশ ও ভগবান কৃষ্ণকে কেন্দ্র করে তাদের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক কার্যক্রম পরিচালিত হয় । ভক্তিযোগ বা কৃষ্ণভাবনামৃত সংস্কৃতি হাজার বছর ধরে শুধুমাত্র ভারতবর্ষের মধ্যেই সিমা্বব্ধ ছিল । তবে সময়ের ব্যবধানে বিশ্বের বহু দেশে সম্প্রসারণ ঘটেছে ইসকনের।
ইসকনের প্রধান কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে মন্দির নির্মাণ ,শ্রীমদ্ভগবদগীতার শ্রীকৃষ্ণের বাণী প্রচার, ধর্মীয় উপদেশ দেওয়া ,ভক্তি কার্যক্রম এবং দাতব্য সংস্থা পরিচালনা । মন্দির রক্ষণাবেক্ষণ ও আধ্যাত্মিক অনুশীলনও করে থাকে ইস্কন । সংস্কৃতি চর্চার অংশ হিসেবে যোগব্যায়াম ও জীবনযাত্রার উপর শিক্ষামূলক প্রোগ্রাম করে থাকে সংগঠনটি । তাহাছারা দরিদ্রদের জন্য বিনামূল্যে নিরামিষ খাবারও বিতরণ করে থাকে ইস্কন । পশ্চিমা দেশসহ বিশ্বের নানাদেশে ইস্কনের লাখো ভক্ত ছড়িয়ে আছে । এদের মুল নাম ছাড়াও ইস্কনের ভক্ত হিসেবে পৃথক একটি নাম দেওয়া হয়ে থাকে । ইসকনের বিরুব্ধে বাংলাদেশের মৌলবাদীরা যে জঙ্গিবাদের অভিযোগ তুলেছেন তা তারা নিজেদের দিকটা ডাকা দেওয়ার জন্যই বলে থাকেন ,এমনটাই দাবী করে থাকেন অনেক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ । তাদের মতে, আমেরিকা ও ইউরোপ যেখানে ধর্মীয় জঙ্গিবাদের বিরুব্ধে নয়-এগারর পর থেকে লড়ে যাচ্ছেন ,সেই সকল দেশে ইসকনের কর্মকাণ্ড নিসিব্ধ বা উপড়ে ফেলা হতো । বরং এ সকল পশ্চিমা বিশ্বে দিনে দিনে ইসকনের জনপ্রিয়তা ও প্রসারণ ঘটেছে । শুধু তাই নয়, ইস্কনের বিখ্যাত ভক্তদের মধ্যে অনেকেই বিলাসবহুল জীবন ত্যাগ করে ব্রহ্মচারীর জীবন বেচে নিয়েছেন ।ইস্কনের বিখ্যাত ও কোটিপতি সদস্যদের মধ্যে আছেন ফোরড মোটরসের মালিক হেনরি ফোরডের প্রপৌত্র অ্যালফ্রেড ফোরড ,দ্য বিটলসের অন্যতম মুখ জর্জ হ্যারিসন ,কবি অ্যালেন গিনসবারগ এবং অ্যাপেলের প্রাক্তন সিইও স্টীভ জবস এবং বর্তমান ট্রাম প্রশাসনের গোয়েন্দা প্রধানের দায়িত্বে আছেন আমেরিকান হিন্দু তুলসী গ্যাবাড। তিনিও একজন ইসকনের ভক্ত ও সদস্য । বিখ্যাত মানুষদের সমাবেশ যেমন হয়েছে ইসকনে ,তেমনই নানা সময়ে বিতর্কেও জড়িয়েছে ইস্কন । যেমন সংঘ-প্রতিষ্ঠার গোঁড়ার দিকে সিঙ্গাপুরে ইসকন নিসিব্ধ থেকেছে দীর্ঘকাল ।সংঘটির রেজিস্ট্রেশন আটকিয়ে রাখা হয়েছিল । তবে অন্য নাম নিয়ে সেদেশে শুরু হয় ইসকনে্র কর্মকাণ্ড । সেখানে একটি মন্দির আছে । ইস্কন ভক্তরা সেখানে খোলাখুলিভাবে কাজ করেন । সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও কমিউনিস্ট চীনে দীর্ঘদিন ইসলামসহ সকল ধর্মীয় কর্মকাণ্ড নিসিব্ধ ছিল । সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গার পর সেই সকল দেশে ইসকন সহ সকল ধর্মের কর্মকাণ্ড নূতনভাবে শুরু হয় । এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে এখনও ইস্কন তার কর্মকাণ্ড চালাতে পারেনি ঐ সকল দেশের বিধিনিষেধর কারণে । তবে পাকিস্তানে ইস্কনের অন্তত ১২ টি মন্দির রয়েছে বলে সংঘটি দাবি করে ।
বাংলাদেশে ইসকনের কারযকলাপ নিয়ে বলা হচ্ছে যে তারা উগ্র এবং জঙ্গি ধর্মীয় সংগঠন । এটা বলা একেবারেই উচিত নয় ।তারা হয়তো ধর্মীয় রক্ষণশীল সংগঠন কিন্তু রক্ষণশীলতার প্রচার বিভিন্ন ধর্মের অনেক সংগঠনই করে থাকে । বাংলাদেশে ইসকনের বিরুব্ধে যে মুল অভিযোগটা নানা সময়ে ওঠে , তা হলো ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাদের ব্যাপক ভক্ত সংখ্যা থাকায় তারা সেটাকে কাজে লাগিয়ে নানা সময়ে বাংলাদেশের নানা ইস্যুকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে গেছে ।ভারতের হস্তক্ষেপ চেয়েছে । সম্প্রতি বাংলাদেশ ইস্কনের সঙ্গে সম্পৃক্ত কিছু সন্ন্যাসীর মুখে ভারতে মুলত বিজেপি নেতা কর্মী সমর্থকদের মধ্যে প্রচারিত জয় শ্রী রাম শ্লোগান শুনতে পাওয়া এই ভারত যোগের অভিযোগ দৃঢ় হয় । এখানে ইসকনের সাথে ভারতের সম্পর্কের ব্যাপারটিই মুখ্য হয়ে উঠেছে সাম্প্রতিক বাংলাদেশ রাজনীতির ভারত-বিরুধি প্রবণতার প্রভাবে ,এমনটাই অনেকে মনে করেন ।
এবার মৌলবাদীদের জঙ্গিপনা বিষয়ে একটু আলোচনা করা যাক । গত ৫ই আগস্টের পর স্বভাবতই আর্মি ব্যাকড ডঃ ইউনিসের পোস্টার সরকারের মুল চালিকাশক্তি জামায়াত ইসলামী । এই জামায়াত বঙ্গবন্ধু স্মৃতি যাদুঘর সহ আওয়ামী তথা ৭১ এর মুক্তিযুব্ধের চেতনার পক্ষের অসংখ্য স্থাপনা ধ্বংস করেছে । খুন করেছে আওয়ামীলিগাদের । খুন করেছে পুলিশকে , আনসারকে । আর বাই ডিফল্ট আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক মনে করা হিন্দুদেরকে গণহারে আগুন-হত্যা- ধর্ষণ সব ধরনের অত্যাচারই করেছে, তা এখনও চলমান । কিন্তু তাদের ধ্বংসাত্মাক কর্মকাণ্ড এই ধারায়ই সীমাব্বধ নেই । আওয়ামী বিরোধী রাজনীতি করা লোকজনও তাদের হাতে আক্রান্ত হচ্ছে । পাহাড়ের সমীকরণ বাদই দিলাম, বাম সমীকরণও বাদ দিলাম । কিন্তু পীরদের দরগাহও আগুন , ভাংচুরের শিকার হচ্ছে । তারাও তো আওয়ামী বিরোধী । তাদেরকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছ ।
একদিকে জামায়াত-শিবির যেমন মুক্তিযুব্ধের পক্ষের মানুষদের আক্রমণ ও মুক্তিযুব্ধের চেতনা ধ্বংসের মাধ্যমে ৭১ এর পরাজয়ের প্রতিশোধ নিচ্ছে । পাশাপাশি তারা অন্যান্য ইসলামিক দলগুলিকে নিয়ে ভবিষৎ ক্ষমতায় যাওয়া ও ইসলামি খেলাফত কায়েমের স্বপ্ন দেখছে । জামায়াত-শিবির ইউনুস সরকারকে সামনে রেখে এবং এই সরকারের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে একদিকে যেমন বিএনপি র নেতাকর্মীরা পরিবহন সেক্টর থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায়ের ইজারা ঘাট পর্যন্ত দখল বানিজ্যে ব্যাস্ত , তখন অন্যদিকে জামায়াত-শিবির ,ছাত্র জনতার অন্তরালে সমন্বয়কের ভূমিকায় থেকে প্রশাসনে নিজেদের লোক বসিয়ে প্রশাসনকে সাজাচ্ছে । এই কাজে তারা সফলও হয় ।
উপমহাদেশের বাংলাদেশ অংশের আল-কায়েদা জঙ্গিনেতা যার বিরুব্ধে অসংখ্য খুনের মামলা আছে , সেই জসিমুদ্দিন রাহমনি সহ অসংখ্য আনসারুল্লাহ বাংলা টিম , হিযবুত তাহরির , জে এম বি ( জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ ) এর ভয়ঙ্কর জঙ্গি নেতা কর্মীদের জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয় । পুলিশের হিসাব মতে, নরসিংদী জেল সহ দেশের বিভিন্ন জেল থেকে তিন হাজারের অধিক আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে জঙ্গিরা পালিয়ে যায় । পুলিশ এ পর্যন্ত এগারশ আগ্নেয়স্ত্র উব্ধার করতে সমর্থ হয় । বাকিগুলি এখনো উব্ধার করা সনভব হয়নি ।
পাঠক, ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শাসনামলে সেই বাংলা ভাই এর কথা মনে আছে( আসল নাম সিদ্দিকুর রহমান ) ? সেই বাংলা ভাই ও শাখায়ক আব্দুর রহমান দুই জঙ্গি নেতা উত্তর বঙের রাজশাহীর বিস্তৃন অঞ্চল জুড়ে নিয়মতান্ত্রিক সরকারের পাশাপাশি প্যারালাল জঙ্গি তালেবানি শাসন কায়েম করে অসংখ্য বাম , মুক্তিযুব্ধা ও প্রগতিশীল নেতা কর্মীদের হত্যা করে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল । তারাও এক সময় শিবিরের ক্যাডার ছিলেন । বিগত আওয়ামী সরকারের পনর বৎসরের শাসনামলে বিভিন্ন সময়ে জেএমবি বা আনসারউল্লা বাংলা টিমের যে সকল জঙ্গি ধরা পরেছে বা পুলিশের গুলিতে মারা গেছে ,পুলিশি তদন্তে বেরিয়ে আসে এক সময় তাদের অনেকে জামায়াত-শিবিরের সাথে সম্প্রীত ছিল । ২০০৪ সালে জামায়াত-শিবিরের একযুগে একই সময়ে সারাদেশের ৬৩ টি জেলায় বোমা হামলা চালিয়ে শক্তি প্রদর্শনের কথা দেশের মানুষ কি ভুলে গেছে ? মানুষ ভুলেগেছে কি শিবিরের রগ কাটার রাজনীতি কথা?
ইস কনের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চ ও বাংলাদেশ সম্মিলিত সংখ্যালঘু জোট নামে দ্যুটি সংগঠন বর্তমানে সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের ব্যানারে সংখ্যালঘুদের ৮ দফা দাবি নিয়ে নিয়মতান্ত্রিকভাবে আন্দোলন করছে দীর্ঘ দিন ধরে । সেই জোটের মুখপাত্র করা হয়েছে চিন্ময় কৃষ্ণ প্রভুকে ।গত ২৫ ষে অক্টোবর চত্রগ্রামে ৮ দফা দাবিতে মহা সমাবেশ করেছিল বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চ । সেই সমাবেশে ভাষণ দিয়েছিলেন চিন্ময় কৃষ্ণ দাস প্রভু । সেই সমাবেশে দুই লক্ষাধিক মানুষের সমাগমে ৭১এর পরাজিত শক্তির দোসরা গাবরে যায় । তারপর ৩১ অক্টোবরে চিন্ময় কৃষ্ণ প্রভু সহ ১৯ জনের বিরুব্ধে সেই সমাবেশে জাতীয় পতাকার অবমাননার দায়ে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করেন বিএনপির স্থানীয় নেতা ফিরোজ খান । পরবর্তীতে সরকার উদ্দশ্যপ্রনিতভাবে সেই মামলায় চিন্ময় কৃষ্ণ প্রভুকে গ্রেপ্তার করেন । সেই সাথে সনাতনীরা প্রশ্ন রাখেন, দ্বিতীয় স্বাধীনতার নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে কিংবা পাকিস্তানের জাতির পিতা কায়েদা আজমের ছবির নীচে পাকিস্তানের পতাকা ও বাংলাদেশের পতাকা টাঙ্গিয়ে তাদের দিবস পালন করা হয়, তখনকি আমাদের জাতীয় পতাকার অবমাননা হয়নি ?
বিভিন্ন সময়ে জঙ্গিরা পতাকা বিছিয়ে নামাজ পড়তে দেখা গেছে বা ৫ই আগস্টের পর বিভিন্ন সময়ে আগস্ট বিল্পবের সমর্থকেরা পতাকা ,জাতীয় সংগীত ,বদলের দাবি তুলেছেন , তখন কি জাতীয় পতাকা বা সঙ্গীতের অবমাননা হয়নি ? কিংবা মৌলবাদী জামায়াত-শিবিরের মিছিল থেকে যখন শ্লোগান দেওয়া হয় একটা করে ইসকন ধর ,একটা করে জবাই কর / একটা করে হিন্দু ধর , একটা করে জবাই কর । কই এই সাম্প্রদায়িক উসকানর জন্য কারো বিরুব্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা হয়েছে বলে জানা নেই । অথবা বিজয় দিবসে জয় বাংলা শ্লোগান দেওয়ার অপরাধে দুই যুবকে পিটিয়ে হত্যা করে জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসী গং দের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তা জানা নেই । কাজেই ইসকন নয় ,জামায়াত-শিবির মৌলবাদী সংগঠনগুলিকে নিসিব্ধ করতে হবে ইহা সময়ের দাবী ।
Posted ৫:৪১ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪
nyvoice24 | New York Voice 24