
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট
বুধবার, ০১ জানুয়ারি ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট : ১১:২৮ পূর্বাহ্ণ
ড. পল্টু দত্ত
জীবন এক যেন বহতা নদী। এগিয়ে চলাই জীবনের একমাত্র কাজ। পেছনে তাকানোর কোন ফুরসৎ নেই। ভাববার সময় নেই। সময় যে সীমিত। অন্তত: মানুষ প্রজাতির জন্য। প্রতিটি নদীই কালের জীবন্ত সাক্ষী। এর নিজস্ব অনন্য যাত্রা যা ইতিহাসের হাত ধরে এগিয়ে চলেছে অনন্তকাল ধরে এবং চলতে থাকবে আরো বহুযুগ। প্রতিটি নদীরই রয়েছে নিজস্ব একটি গল্প যা প্রায়শই এই সুন্দর পৃথিবীর মৃত্তিকা মায়ের বুকে অপার মহিমায় হামাগুড়ি দিয়ে এঁকে বেঁকে সর্পিলাকারে চলার অভিজ্ঞতায় পূর্ণ। কি চমৎকার সাদৃশ্য রয়েছে এই নদীদের সাথে মানুষের। শুধু উৎস পথটা একটু ভিন্ন কিন্তু চলার পথটা একই সমীকরণে বাঁধা। নদী বহতা অনন্তকাল মিশে যায় সাগরের মোহনায়। নদী-এবং মানুষের চলার পথ কখোনই মসৃণ নয়। কখনো খরা মওসুমের মতো তাপ-দাহের অস্থিরতা, কখনো বা আষাঢ়ের অঝর বৃষ্টিপাত, কিংবা হিমাংকের নিচে শীতের কনকনে ঠাণ্ডা আর তুষারের ভয়ংকর হাঁড়কাঁপানো আঁচড়িয়ে পরা বাতাসের তাণ্ডবটা। তারপরেও সকল পরিস্থিতিকে গ্রহণ করেই আমাদেরকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হয়। নদী আর মানুষের যাত্রা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে প্রকৃতি যতটাই শক্তিশালী হোক না কেন, চলার পথে যত বাধাই আসুক না কেন,মানুষ আর নদী সবকিছুকে অতিক্রম করার অদম্য সাহস আর শক্তি রাখে। দুমড়ে গেলেও মানুষ আবার ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায় এবং ভবিতব্যের দিকে হাত বাড়িয়ে ফের চলতে থাকে। আমাদের মনে রাখা উচিত যখনই জীবন আমাদের চলার পথে কোন বক্ররেখা ছুড়ে দেয় – হাল ছাড়তে নেই, এগিয়ে যেতে হবে, কারণ আমরা কখনই জানি না যে প্রতিটি বাঁকের চারপাশে কি আশ্চর্যজনক বিস্ময় অপেক্ষা করছে। জীবন যে এক বিস্ময়কর এবং নতুনত্বের ছোঁয়ায় আবর্তিত।
জীবন যেন উত্থান-পতনের, সুখ-দুঃখ আর হৃদয় নিংড়ানো অনুভূতির স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ। সময়ের বিবর্তনে জীবন থেকে আরেকটি বছর চলে গেল। আমরা আরেকটি নতুন বছরকে বরন করে নিচ্ছি। এই নতুন আর পুরাতনের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আমরা হিসেব কষি জীবনের, পাওয়া-না পাওয়ার, সাফল্য-অসাফল্যের, উচ্ছ্বাস-অলসতার, আনন্দ-বেদনার ইত্যাদি ইত্যাদি। গত কয়েক বছর ধরে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের সাফল্যের চেয়ে অসাফল্যের পাল্লাটাই বেশী ভারী ছিলো। কতো কিছুই না ঘটে গেছে গত কয়েক বছরে। কোভিড-১৯ মহামারি বিশ্ববাসীর জন্য সৃষ্টি করেছিলো এক দুর্ভাগ্যজনক অধ্যায়, এই শতাব্দীর ভয়ানক ট্র্যাজিডী। বিশ্ববাসী নির্বাক দৃষ্টিতে বুকে পাথর চাপা দিয়ে জীবনাতিপাত করেছে অব্যক্ত শব্দের অনুরণনে। এই ভয়ানক মহামারী সারা বিশ্বের মানুষের জীবনে অভূতপূর্ব প্রভাব ফেলেছে। ৩০শে জানুয়ারি ২০২০ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোভিড-১৯-কে পাবলিক হেলথ ইমার্জেন্সি হিসাবে ঘোষণা করার পর থেকে প্রায় সাড়ে তিন মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়। কোভিডের ভয়ানক পরিস্থিতি কাটতে না কাটতেই সাড়া বিশ্বে বেজে উঠে যুদ্ধের দামামা। পশ্চিমা রাষ্ট্রপ্রধানদের একগুঁয়েমি, আধিপত্য-বাদী পশ্চিমাদের পররাষ্ট্রনীতি আর ন্যাটোর অগ্রহণযোগ্য ও অনৈতিক পূর্ব ইউরোপে সম্প্রসারণের জের হিসেবে সৃষ্ট ইউক্রেইন-রাশিয়ার যুদ্ধ সংকট এবং সর্বশেষ ইজরাইল-গাজার যুদ্ধের ভয়ানক পরিস্থিতি বিশ্বকে টেনে নিয়ে যায় এক অমানবিক বিপর্যস্ত বিপন্ন পরিস্থিতির দ্বার প্রান্তে। কোভিড আর যুদ্ধের কারণে সাড়া বিশ্বে নেমে আসে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও মানবিক বিপর্যয়। আকাশ ছোঁয়া মুদ্রাস্ফীতি, অর্থনৈতিক মন্দা, সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা, সব কিছুই গ্রাস করতে থাকে মানুষের প্রাত্যহিক জীবন যাত্রাকে। তাই ২০২৪ সালটা ছিলো আমাদের সকলের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর। নানা চ্যালেঞ্জ আর সমস্যায় জর্জরিত একটি সময়কাল যা বিশ্বমানবটার জন্য নিয়ে আসে মহা বিপর্যয়। বিশ্ববাসীকে গত কয়েক শতাব্দীতেও এমন একটি সময়ের সন্মূখীন হতে হয়নি।
আমরা যারা বাংলাদেশ ভূখণ্ডের মানুষ তাদের সকলের জন্য এই বছরটি আরো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ৫ই আগস্ট ঘটে যাওয়া বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের গন জোয়ারে গত সরকারের পতন হওয়ার পর থেকে দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকে বাংলাদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সহ সার্বিক জীবন যাপনের পরিস্থিতি। এক ভয়াবহ অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মুখোমুখি দেশবাসী। তত্বাবধায়ক সরকার আছে বটে, নানা সংস্কারের কার্যক্রমও চলছে কিন্তু সমাজের সর্বত্র বয়ে চলছে এক অসুস্থ সহ্য-হীন বর্বরতা আর অনিয়মের ঝড়। এই ঝড় একদিন যে তাণ্ডবে পরিণত হবে তা হয়তো আমরা অনেকেই টের পাচ্ছি না। তবু বাঙালী যেন হাল ছাড়বার পাত্র নয়।
তাই আজ আমরা নতুন বছরের সূচনালগ্নে অতীতকে স্মরণ করে আগামীর জন্য স্বপ্ন আর প্রত্যাশার চাদর বুনে যাচ্ছি। শতো প্রতিকূলতার মাঝেও আমরা এগিয়ে চলেছি। বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে দূর্বার গতিতে। বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের মতো। আমরা এখন ২০২৫-এর দিকে তাকিয়ে আছি, প্রত্যাশা এবং আশার অনুভূতি নিয়ে। আমরা যে চ্যালেঞ্জগুলির মুখোমুখি হয়েছি তা ছিলো ভয়ানক। তবে আমাদের উদ্ভাবনা, মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা এবং সমস্যা মোকাবেলায় মানসিক ঋজুতা ছিলো তীব্র। জাতী হিসেবে বাঙালী শৌর্য ও বীর্যের। আমরা যেন লড়াকু সৈনিক। সমস্ত বাধা-বিপত্তিকে পাশ কাটিয়ে আমরা আবার শিরদাঁড়াকে শক্ত করে দাঁড়াতে পেড়েছি। আমাদের প্রত্যাশা এখন আগামীকে নিয়ে। আসন্ন বছরটি বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, কৃষি, শিক্ষা এবং চিকিৎসা ক্ষেত্রে আরও অগ্রগতির প্রতিশ্রুতি নিয়ে আসবে সেটাই সমগ্র জাতীর প্রত্যাশা। অতীতে, বাংলাদেশ ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক অস্থিরতার মতো অসংখ্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিলো। এইসব প্রতিকূলতার মধ্যেও বাংলাদেশের জনগণ তাদের দৃঢ়তার জন্য এগিয়ে যেতে পেরেছে। সময়ের সাথে সাথে,বাংলাদেশ সরকার শক্তিশালী অবকাঠামো তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। মানুষের জীবনে লেগেছে উন্নয়নের ছোঁয়া। বেড়েছে বিনিয়োগ। সমাজের প্রতিটি স্তরে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য সরকার নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
আমরা আজ এক নতুন ভোরের প্রত্যাশায়। অতীতের সমস্ত চ্যালেঞ্জ, ভুল-ভ্রান্তি আর বিশ্ব পরিস্থিতি থেকে সার্বিক শিক্ষা নিয়ে আগামী দিনটিকে এক নতুন প্রত্যয় আর বিনির্মাণের বাতাবরণে থরে থরে সাজাবো এটাই হোক নতুন বছরের প্রত্যাশা। গত বছরের সকল বাধা-বিপত্তিকে ঋজুতার সাথে অতিক্রম করে নিজস্ব গতিপথ নির্ধারণে বাংলাদেশের অটল দৃঢ়তার প্রমাণ রেখেছে শুধু বাংলাদেশের জনগণের জন্যই নয় বরং বিশ্ববাসীর কাছেও। মানব-সম্পদ রপ্তানি, পোশাক শিল্প, কৃষি, ফার্মাসিউটিক্যালস, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য এবং প্রযুক্তির মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলি বৃদ্ধিতে চামড়া-জাত অবদান রেখে অর্থনৈতিকভাবে, দেশটি অগ্রগতি অব্যাহত রেখেছে। অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিগত সরকারের মনোযোগ ফলপ্রসূ হয়েছে। তবে দুর্নীতিতেও সয়লাব হয়ে পড়েছিলো পুরো দেশটি। অন্যায়, রাজনৈতিক, অত্যাচার, অপহরণ, বাক-স্বাধীনতাকে পিষিয়ে মারা সহ সার্বিক পরিস্থিতি যেন দুর্বৃত্যায়নের অভয়ারন্যে পরিণত হয়েছিলো পুরো দেশটি। ছাত্র আন্দোলনর গন-জোয়ারে সরকারের পতন হয়। তবে বিগত সরকার স্মার্ট ও ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপরেখাকে সামনে রেখে পরিবহন নেটওয়ার্ক এবং জ্বালানি প্রকল্পগুলিকে সারা দেশে আধুনিকীকরণে যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছে এবং এই প্রক্রিয়াটি আগামীতেও অব্যাহত থাকা জরুরী। বাংলাদেশ বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জগুলি ছাড়াও নানা ধরনের আভ্যন্তরীণ সমস্যারও সন্মূখীন হয়েছে বার বার। দেশীয় ও আঞ্চলিক সন্ত্রাসবাদ, জলবায়ু পরিবর্তন, লাগাতার রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক চাপ, উচ্চা মুদ্রাস্ফীতি, স্বাধীনতা বিরোধীদের সন্ত্রাসী কর্মতৎপরতা, বিদেশীদের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট সহ নানাবিধ সমস্যায় সম্মুখীন হয়েছে বাংলাদেশের জনগণ। আজ নূতন তত্বাবধায়ক সরকার ও জনগণের সামনে বিরাজ করছে নতুন এক বাস্তবতা। সহজ করে বলতে গেলে বলা যায় বাংলাদেশ আজ সত্যিই ভালো নেই। দুর্নীতিবাজ সরকারের পতন হয়েছে বটে কিন্তু নতুন বাস্তবতা যেন এক মহাসংকট নিয়ে এসেছে। একের পর এক সমস্যা সমাধানে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সক্রিয় পদক্ষেপে নানা ক্ষেত্রে আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি সত্ত্বেও, দুর্নীতি, দারিদ্র্য এবং শ্রেণী বৈষম্যের ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকদের অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন কৌশলগুলির সংপৃক্ততাকে আরো কঠোর হস্তে প্রয়োগ করে একটি টেকসই সমাজ বিনির্মাণ করতে হবে। একটি সমৃদ্ধ, দুর্নীতিমুক্ত, অবাধ ন্যায্য, মানবিক ও গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় উন্নীত করতে কয়েকটি বিষয়ে বেশ জোড় দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে সরকার সহ প্রতিটি জনগণকে সম্মিলিতভাবে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে কাজ করতে হবে।
প্রথমত: টেকসই উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখতে হবে। বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার অচলায়তন ভেদ করে একটি অবাধ, সুস্থ এবং জনগণের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আগামীর সরকার দৃঢ় মনোভাবের সাথে জাতীর স্বার্থে বর্তমানের উন্নয়নের ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে এটাই জাতীর প্রত্যাশা। বিগত বছরের উন্নয়নের গতিপথকে অনুসরণ করে বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে এবং দুষ্টপাতগ্রস্থ রাজনীতিকে ব্যবসাীয়ক এবং উন্নয়নের ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে হবে। অর্থনৈতিক অগ্রগতির সাথে সাথে উন্নত বিশ্বের মডেলে গ্রিন অর্থনৈতিক প্রকল্পে উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশ এখন সময়ের বিবর্তনে ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে পা দিচ্ছে। বাংলাদেশে ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন এখন এমন এক পর্যায়ে যেখানে প্রযুক্তি অগ্রগতির দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। ফিন-টেক, ই-কমার্স, এবং স্মার্ট গভর্নেন্সের উদ্ভাবনগুলি সমাজের সর্বত্র নাগরিকদের পরিষেবার সাথে জড়িত হওয়ার জাতীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে তা নিশ্চিত। একটি ন্যায়পরায়ণ সমৃদ্ধ সমাজব্যবস্থার একটি মৌলিক উপাদান হলো সামাজিক অন্তর্ভুক্তি ও সমতা। কাউকে পিছিয়ে না রাখার বাধ্যবাধকতা স্বীকার করে, সামাজিক অন্তর্ভুক্তিমূলক উদ্যোগগুলিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। আমাদের সকলের প্রত্যাশা সরকার সমাজের সর্বস্তর থেকে ধীরে ধীরে বহুমাত্রিক দুর্নীতি ও দূর্বৃত্তায়নকে কঠোর হস্তে দমন করে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক নিরাপত্তা এবং দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচিতে মনোযোগ দেবে যাতে উন্নতির সুফল সুষমভাবে বণ্টন করা হয়।
আরেকটি ব্যাপারে সরকারের বিশেষ মনোযোগ প্রয়োজন সেটা হলো আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি। বাংলাদেশ বিশ্ব সম্প্রদায়ের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকবে এটাই জাতী হিসেবে জনগণের প্রত্যাশা। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা, রোহিঙ্গা সংকট সমাধান এবং অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব বৃদ্ধির জন্য সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টা কূটনৈতিক প্রচেষ্টার অগ্রভাগে থাকবে। তবে একটি সমৃদ্ধ জাতী হিসেবে আমাদের সকলের প্রত্যাশা একটি শিক্ষা ও সংস্কৃতিভিত্তি নবজাগরণ। অর্থনীতি ও রাজনীতির ক্ষেত্র ছাড়িয়ে বাংলাদেশ এখন একটি সাংস্কৃতিক নবজাগরণের জন্য প্রস্তুত। শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য এবং ঐতিহ্যের বাতাবরণে বেড়ে উঠা এই জাতী আবার এক নতুন অবয়বে জেগে উঠবে। একটি সমৃদ্ধশালী সমাজের মৌলিক প্রতিষ্ঠান হলো শিক্ষা যা একটি জাতীর মেরুদণ্ড। জাতীর উন্নয়ন, প্রগতি ও নৈতিক বিকাশে শিক্ষা অপরিহার্য। সুস্থ ও গঠনমূলক শিক্ষার মাধ্যমেই মানব উন্নতির মৌলিক অধিকার বৃদ্ধি পায়। একজন ব্যক্তির চিন্তায়, চেতনায়, মননে ও সামাজিক দক্ষতা বৃদ্ধিতে আনে ৠদ্ধতা। শিক্ষার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি পুরনো অজ্ঞানতা থেকে মুক্তি পায় এবং নতুন ও আধুনিক ধারণার সাথে পরিচিত হয়। তবে সেই ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য শিক্ষা হতে হবে নৈতিক, প্রায়োগিক ও সমসাময়িক। একটা বিষয় আমাদের সবাইকে ভাবিয়ে তুলে আর তা হলো যতোই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ছে, যতোই মানুষ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে, এই বিশ্বায়ন আর প্রাপ্তিটার সমাজে মানুষ ততই আত্মপরিচয়ের সংকটে ভুগছে এবং নৈতিক অধঃপতনে নিমজ্জিত হচ্ছে। যা সত্যিকারের সুশিক্ষার পরিপন্থী। তাই শিক্ষাকে হতে হবে নৈতিক ও রাজনৈতিক পক্ষপাত মুক্ত।
জাতীয় উন্নয়নে সংস্কৃতির রয়েছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব। সংস্কৃতি একটি সমৃদ্ধ এবং বিস্তৃত শব্দ। সংস্কৃতির মাধ্যমে একটি জাতি আত্মসম্মান ও আত্মপরিচয় অর্জন করতে পারে। আমাদের চিন্তা, চেতনায়, আচার-আচরণে, কথা-বার্তায়, চলনে-বলনে, পোশাকে-আশাকে, কর্মে-চাঞ্চল্যে, রাগে-বিরাগে সর্বত্র সরব বিচরণ সংস্কৃতির যা একটি জনগণের চিন্তা, আদর্শ, মূল্য, সংস্কার, ও সামাজিক অবস্থান নির্ধারণ করে। একটি জাতীর ভাষা ও সাহিত্য সংস্কৃতির অংশীদার। ভাষার মাধ্যমেই একটি সমাজ বা জাতীর আদর্শ, মূল্যবোধ, ও ঐতিহ্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। আর সাহিত্যিক ও শব্দশৈলীর মাধ্যমে মানবিক এবং রূপকল্পনায় আদর্শ তৈরি হয়। সংস্কৃতি মানব জীবনের মানদণ্ড এবং নীতি নির্ধারণ করতে সাহায্য করে। একটি সমাজকে সমৃদ্ধ ও ঋজু করে। এই কারণে, সংস্কৃতি জাতীর উন্নতির সাথে অবিভাজ্যভাবে জড়িত রয়েছে এবং এটি একটি জনগণের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং আর্থিক উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আরেকটি দিকে আমাদের মনোযোগ দিতে হবে তা হলো সংখ্যালঘুদের অধিকারকে পূর্ণ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। ৭১এর চেতনাকে সমুন্নত রেখে যে কোন মূল্যে জাতীয় সম্প্রীতি ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। ভেদা-ভেদ এবং অসম সামাজিক ও রাজনৈতিকে পরিহার করতে হবে।
নতুন বছর আমাদের প্রত্যাশাকে নতুন এক উচ্চতায় নিয়ে যাক, যেখানে একটি ঐক্যবদ্ধ এবং সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি। আমাদের জাতির সামনে চ্যালেঞ্জ যতই কঠিন হোক, নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সঠিক এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের মাধ্যমে প্রতিটি বাধা মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে। তাদের দৃঢ় নেতৃত্ব এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার দক্ষতা আমাদের জাতিকে একটি স্থিতিশীল ও অগ্রগতির পথে পরিচালিত করবে। আমাদের সকলের দায়িত্ব যে আমরা বিভেদ ভুলে, ধর্ম, বর্ণ, জাতি, এবং সম্প্রদায়ের সীমানা পেরিয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকি। এই মাটি আমাদের সবার, এটি আমাদের শিকড়, আমাদের আত্মপরিচয়ের প্রতীক। আমরা একসঙ্গে দাঁড়াব, যেন কেউ আমাদের ঐক্যের দৃঢ় প্রাচীর ভাঙতে না পারে। নতুন বছরটি কেবল একটি সময়ের সূচনা নয়, এটি আমাদের প্রতিশ্রুতির নবায়ন – আমাদের বাংলাদেশকে আরও উন্নত, ন্যায়পরায়ণ এবং মানবিক দেশ হিসেবে গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি। আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের উদ্ভাবনী চিন্তা, আমাদের শ্রমশক্তি, এবং আমাদের মানসিক দৃঢ়তা যে কোনো চ্যালেঞ্জকে পরাভূত করতে যথেষ্ট। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সহায়তায় জাতি একটি নতুন গতিপথে পা দেবে, যেখানে শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি এগিয়ে নিয়ে যাবে একটি আধুনিক, প্রগতিশীল সমাজ। আমরা একসাথে কাজ করব যেন সকল ধর্ম, বর্ণ, এবং সম্প্রদায়ের মানুষ এই জাতির উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে। আমাদের প্রত্যাশা একটি এমন বাংলাদেশ, যেখানে প্রতিটি নাগরিক সমান সুযোগ পায় এবং শান্তি ও সমৃদ্ধি প্রতিটি ঘরে পৌছায়। এই জাতি আমাদের সবার – আমাদের রক্ত, আমাদের ঘাম, এবং আমাদের স্বপ্নের প্রতিফলন। একসঙ্গে আমরা একটি দুর্গ গড়ে তুলব যা কোনো চ্যালেঞ্জকে ভাঙতে পারবে না। ঐক্যের শক্তিতে আলোকিত হবে আমাদের সোনার বাংলাদেশ।
ড. পল্টু দত্ত
শিক্ষক, গবেষক এবং কলামিষ্ট
Posted ১১:২৮ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ০১ জানুয়ারি ২০২৫
nyvoice24 | New York Voice 24