হোমকেয়ারে পিপিএল : স্বজনকে সেবাদানের সুযোগ বন্ধ

ফুরিয়ে আসছে ফাঁকির দিন

নিজস্ব প্রতিবেদক   প্রিন্ট
শুক্রবার, ৩১ জানুয়ারি ২০২৫   সর্বশেষ আপডেট : ১:১২ অপরাহ্ণ

ফুরিয়ে আসছে ফাঁকির দিন

পিপিএল (পাবলিক পার্টনারশিপ এলএলসি) নামক একটি কোম্পানী এসেছে হোমকেয়ার ব্যবসার সামগ্রিক মনিটরিংয়ের অভিপ্রায়ে। নিউইয়র্ক স্টেট হেল্থ ডিপার্টমেন্ট অনুমোদিত এই সংস্থা হোম হেল্থ কেয়ার গ্রহণকারিগণের দৈনন্দিন সেবা-কার্যক্রম তদারকি করবে। অর্থাৎ রোগী ঠিকমত সেবা পাচ্ছেন কিনা সেটি তদারকি করবে। সিডিপ্যাপের আওতায় সেবা গ্রহিতাগণকে এপ্রিলের আগেই পিপিএল’র সাথে তালিকাভুক্ত হবার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। হঠাৎ কেন পাল্টে গেল হোমকেয়ার সার্ভিসের তদারকি? এ প্রশ্নের জবাবে নিউইয়র্ক সিটির ব্রুকলীনে প্রোহেল্থ হোমকেয়ারের চিফ এক্সিকিউটিভ মামুনুর রশীদ জানান, জর্জিয়াভিত্তিক পিপিএল নিউইয়র্কের স্টেট গভর্ণরকে কনভিন্স করতে সক্ষম হয়েছেন যে, সিডিপ্যাপ (কনজ্যুমার ডিরেক্টেড পার্সনাল অ্যাসিস্ট্যান্স প্রোগ্রাম)’র প্রোগ্রামে সেবা গ্রহিতারা যথাযথভাবে সেবা পাচ্ছেন না মনিটরিংয়ের অভাবে। এখোন যে ধরনের সেবার জন্যে স্টেট স্বাস্থ্য দফতরের অর্থ ব্যয় হচ্ছে, আমি একইধরনের সেবার নিশ্চয়তা দেব। তবে ব্যয়ের পরিমাণ কমবে। অর্থাৎ এখোন অর্থের অপচয় ঘটছে। পিপিএলকে মনিটরিংয়ের দায়িত্ব দেয়া হলে সেবার মান অপরিবর্তিত থাকবে, ব্যয়ের পরিমাণ কমবে।
হোমকেয়ার ব্যবসায় তুলনামূলকভাবে জুনিয়র হলেও বিভিন্নভাবে অভিজ্ঞতা অর্জনকারি মামুনুর রশীদ বলেন, কম্যুনিটিতে এই ব্যবসায় হঠাৎ করে অনেকেই ফুলে ফেপে উঠেছেন। এ বিষয়টিও বর্তমানের কড়াকড়ি আরোপকে উৎসাহিত করেছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ মনোযোগী হয়েছেন ত্রুটিগুলোকে সেরে নিয়ম-শৃঙ্খলায় ফিরিয়ে আনতে। উল্লেখ্য, হোমকেয়ার সার্ভিস শত বছরের পুরনো একটি ব্যবস্থা, যার সুফল পেয়ে আসছেন চলতে অক্ষম মানুষেরা। প্রতি বছরই মোটা অর্থ ব্যয় করে স্টেট স্বাস্থ্য ডিপার্টমেন্ট। জুইশ, রাশিয়ান, আফ্রিকান-আমেরিকানের পর চীনারা এই ব্যবস্থায় সম্পৃক্ত রয়েছেন। ৫/৬ বছর যাবত তা সম্প্রসারিত হয়েছে বাংলাদেশীদের মধ্যেও। অসুস্থ মা-বাবা, ভাই-বোন, দাদা-দাদি অথবা নানা-নানীকে নিজ ঘরেই চিকিৎসা-সেবার মাধ্যমে মোটা অর্থ আয়ের ব্যপারটি সকলকেই আকৃষ্ট করেছে। আর এ সুযোগে গড়ে উঠেছে অনেক এজেন্সি। কেউ লাইসেন্স পেয়েছেন, আবার কেউ এজেন্ট বা ব্রোকার হিসেবে কাজ করছেন। উভয় ক্ষেত্রেই রয়েছে বাড়তি আয়ের সুযোগ। অভিযোগ রয়েছে যে, অনেকের মা-বাবা, দাদা-দাদি কিংবা নানা-নানীকে সেবা প্রদানের প্রয়োজন হয় না। কাগজে-কলমে সেবা প্রদানের ঘটনা ঘটছে। অভিযোগে আরো জানা গেছে, সেবা প্রদানকারির বড় একটি অংশ ফুল টাইম চাকরি করছেন, একইসাথে হোমকেয়ারের সেবাদাতা হিসেবে সাপ্তাহিক পারিশ্রমিকের চেক ড্র করছেন। এরফলে কেউ কেউ সপ্তাহে ১৪০ ঘন্টা কাজের বেতন ড্র করছেন, অর্থাৎ দৈনিক ২০ ঘন্টা করে কাজ করেন; যা বাস্তবে অকল্পনীয়। এসব বিষয় কর্র্তপক্ষ জানতে পেরেই স্টেট গভর্ণর ক্যাথি হোকুল কৌশলে জর্জিয়াস্থ পিপিএল’কে নিয়োগ করেছেন নিউইয়র্কের হোমকেয়ার ব্যবসার তদারকির একক দায়িত্ব পালনের জন্যে। এ প্রসঙ্গে মামুন বলেন, পিপিএল তৎপর হওয়ার পর নিউইয়র্ক স্টেটের ৬ শতাধিক হোমকেয়ার এজেন্সি-তে তালা ঝুলতে পারে অথবা তারা পিপিএল’র ব্রোকার হিসেবে কিংবা তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা রোগীগণকে পিপিএল’র কাছে সমর্পণের মাধ্যমে এককালিন মোটা অর্থ পেতে পারবেন। এর বাইরে তারা ঐসব সেবা প্রদানকারিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে কমিশন বাবদ কিছু আয়ে সক্ষম হবেন না। আর যদি সবগুলো বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে হয়তো ফুল টাইম কর্মচারি হিসেবে হাজার দুয়েক মানুষ বেকার হয়ে পড়বেন। এটি স্টেট গভর্ণরের দেখার বিষয় নয়। কারণ অনিয়মসমূহ দূর করা সম্ভব হলে বছরে কয়েক বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় হবে। ব্রুকলীনের চার্চ-ম্যাকডোনাল্ডে ১২ বছরের পুরনো টিডিএস ইন্স্যুরেন্স ব্যবসায় সুনাম অর্জনের ধারাবাহিকতায় অভিজ্ঞ মামুন আরো বলেন, তবে পিপিএল একচ্ছত্র আধিপত্য পেলে এই সেক্টরের অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে-তা সময়েই জানা যাবে। তবে মানুষের সেবা নিরবিচ্ছিন্নভাবে-নির্বিঘ্নে প্রদানের ব্যাপারটি একক প্রতিষ্ঠানের হাতে ন্যাস্ত করা হয়তো ঠিক হচ্ছে না। এ নিয়ে কম্যুনিটির অনেকে সরব হলেও সেই আন্দোলন-লবিংয়েও ছিল বিভক্তি। যার ফলে সত্যিকারের সুফল আসেনি। পিপিএল’র লবিংয়ের কাছে কম্যুনিটির ব্যবসায়ীগণের লবিং হেরে গেছে।

প্রতীকী ছবি

মামুন বলেন, হোমকেয়ার ব্যবস্থার সাথে কম্যুনিটিকে পরিচিত করা, অসুস্থ মানুষ-জনকে সেবা দেয়া, হাসপাতাল কিংবা চিকিৎসকের চেম্বারে আনা-নেয়া করা, সময় মত ওষধ সেবন, গোসল করানো, স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য পরিবেশন ইত্যাদি কাজে (যতটাই ঘটে থাকুক) লোকজনকে অভিজ্ঞ করতেও অনেকের অবদান অস্বীকারের উপায় নেই। এমনি অবস্থায় প্রযুক্তির মাধ্যমে ৫০/৬০ হাজার মানুষকে সরিয়ে নেয়ার ঘটনাটি হৃদয় বিদারক বৈকি।
পিপিএল এখনো কোন অফিস খুলেনি। সবকিছু ফোন (১-৮৩৩-২৪৭-৫৩৪৬ ), অনলাইনে (pplfirst.com/cdpap.)করছে। এই প্রক্রিয়া কম্যুনিটির অনেকের পক্ষেই অনুসরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। যেহেতু তারা টেকনিক্যাল হ্যান্ডেড নন। মামুন রশীদ বলেন, তারা হয়তো অফিস নেবে, কিন্তু বর্তমানের মত কম্যুনিটির দোর-গোড়ায় কী আসতে পারবে? অর্থাৎ সেবা প্রার্থীরা এক ধরনের অনিশ্চয়তায় নিপতিত হয়েছেন। মামুন বলেন, যারা সেবা নিচ্ছেন তারা কেউই ইংরেজীতে তেমনভাবে কথা বলতে পারেন না। নিজ ভাষায় কথা বলতে না পারলে সেবাদাতাও স্বাচ্ছন্দবোধ করবে না। একইসাথে রোগীর সমস্যা সম্পর্কেও তেমন ওয়াকিবহাল হতে সক্ষম হবেন না। এছাড়া, শোনা যাচ্ছে যে, পিপিএল পুরো ব্যবস্থাকে নতুন করে সাজাতে চাচ্ছে। তার ফলে বর্তমানে সেবা প্রাপ্তির ঘন্টা কমতে পারে। অর্থাৎ সেবা প্রদানকারির আয় কমার আশংকা দেখা দেবে। মজুরিও প্রতি ঘন্টায় ৩ ডলার করে কমতে পারে। এ অবস্থায় অনেকে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে এবং মনোকষ্টে পড়েছেন।
মামুন বলেন, পিপিএল তার কার্যক্রম শুরু করলে সেবাদাতাদেরকে একটি কোর্স নিতে হবে। চিকিৎসা-সেবা সম্পর্কে ন্যূনতম একটি ধারণা থাকতে হবে। এধরনের প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর বর্তমানের মত মা-বাবা, ভাই-বোনকে সেবা দেয়া সম্ভব হবে না। আত্মীয় নন-এমন রোগীকে সেবা দিতে হবে। এরফলে প্রবীনরা পড়বেন আরেক ধরনের সংকটে। নিজ ভাষায় কথা বলা, নিজ সংস্কৃতির আবহে সেবা নেয়ার ব্যাপারটি গভীর এক সংকটে পড়বে। অপর একটি সূত্রে জানা গেছে, তবে কম্যুনিটির সেবা দাতারা যদি কম্যুনিটির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে পারেন, তাহলেও কিছুটা সংকট কমতে পারে। তবে সেবা না দিয়ে বেতন ড্র করার পর ভাগাভাগির বর্তমানের বিশেষ ব্যবস্থাটি অকল্পনীয় হয়ে পড়বে-তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত কয়েক বছর সিডিপ্যাপের তালিকাভুক্ত অনেকেই অসুস্থ না হয়েও ডাক্তারের সার্টিফিকেট নিয়ে হোমকেয়ারের সুবিধা নিয়েছেন। কেউ কেউ মাসের পর মাস বাংলাদেশে অবস্থান করেও চিকিৎসা-সেবা নিয়েছেন। বাংলাদেশ ভ্রমণকালে মৃত্যু হয়েছে এমন ব্যক্তির নামেও হোমকেয়ার অব্যাহত রাখা হয়েছে। সেবা দাতা এয়ারপোর্ট অথবা সুপার মার্কেট কিংবা অন্য কোন অফিসে ফুলটাইম জব করা সত্তে¡ও হোমকেয়ার থেকে নিয়মিত চেক ড্র করছেন। আরো জানা গেছে, একাকী চলতে পারেন না জানিয়ে নিয়মিত হোমকেয়ার গ্রহণকারিরা হেঁটে গ্রোসারি কিংবা রেস্টুরেন্টে যাচ্ছেন অথবা নাতি-পুতিকে স্কুলে নিয়ে যাচ্ছেন এবং বাসায় আনছেন, কিংবা ঘনিষ্ঠ কাউকে চিকিৎসকের কাছেও নিয়ে যাচ্ছেন। কেউ কেউ মসজিদ-মন্দির-চার্চেও যাতায়াত করছেন। ঐ সময়েই দেখা যাচ্ছে যে সেবা প্রদানকারি তাকে সেবা দিচ্ছেন বলে ভাতা ড্র করছেন। এমন কিছু ঘটনা কর্তৃপক্ষের নজরে আসার পরই কৌশলে স্টেট গভর্ণর সিডিপ্যাপের সার্ভিস পিপিএল’র নিয়ন্ত্রণে দেয়ার পরিকল্পনা নিয়েছেন। কারণ, পিপিএল প্রতিটি সেবা গ্রহিতাকে মনিটরিংয়ে রাখবে। একইসাথে সেবা দাতার গতিবিধিও মনিটরিং করা হবে। ফলে সেবা না দিয়েও ভাতা নেয়ার সুযোগ থাকবে না।
জানা গেছে, নিউইয়র্ক স্টেটের কয়েক লাখ মানুষ হোমকেয়ার সেক্টরে রয়েছেন। এরমধ্যে বাংলাদেশীর সংখ্যা ৫০ হাজারের বেশী হবে। অর্থাৎ মোটা আয়ের একটি ব্যবস্থায় তারা ছিলেন। গত দু’তিন বছরে নিউইয়র্কে যারা প্রথমবারের মত বাড়ির মালিক হয়েছেন তার সিংহভাগই হোমকেয়ারের সাথে সম্পৃক্ত। আমেরিকান স্বপ্ন পূরণের পথে হোমকেয়ার ব্যবস্থাকে অনেকে স্থায়ী একটি বন্দোবস্থ ভেবেছিলেন। সেটি এখোন স্বপ্ন ভঙ্গের মত হতে চলেছে। তবে যারা রীতি অনুযায়ী কাজ করবেন তাদের আয়ের পথ সীমিত হবার পরিবর্তে বাড়তেও পারে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। আর যারা এই ব্যবসার নামে অনিয়ম-অনাচার এবং জাল-জালিয়াতিতে লিপ্ত হয়েছেন তাদের এখোন মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনাই প্রবল।

Facebook Comments Box

Posted ১:১২ অপরাহ্ণ | শুক্রবার, ৩১ জানুয়ারি ২০২৫

nyvoice24 |

Address
New York
Phone: 929-799-2884
Email: nyvoice24@gmail.com
Follow Us