
তপন দেবনাথ
প্রিন্ট
রবিবার, ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট : ৯:৩৩ পূর্বাহ্ণ
পৃথিবীর এক নম্বর মধুরতম ভাষা হচ্ছে বাংলা। বর্র্তমানে বিশ্বে প্রায় ত্রিশ কোটি মানুষ বাংলায় কথা বলে। যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ১৫%। এই ভাষার অবস্থান পঞ্চম। আমরা বিশ্বে সেই মহান জাতি যারা ভাষার দাবিতে লড়াই করেছি এবং প্রাণ বিসর্জন দিয়ে মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করেছি। এই একটি মাত্র বিষয়কে কেন্দ্র করে বিশ্বে আমাদের মর্যদাকে উন্নত স্তরে নিয়ে যেতে পারি। ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে। বিশ্ব তা পালন করুক বা না করুক, বিশ্বের সকল দেশ ২১ শে ফেব্রুয়ারি স্মরণ করে সেদিন কী ঘটেছিল বাংলা ভাষা নিয়ে। বাংলা আজ আর শুধু বাঙালির ভাষা হিসেবে আবদ্ধ নেই। বিশ্বের অনেক দেশে বাংলা ভাষার চর্চা হচ্ছে। আমরা সে বিষয়ে পরে আলোকপাত করব। তবে এখানে বলে রাখতে চাই যে সিয়েরা লিয়নে বাংলাকে দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।
বাংলা অতি প্রাচীন ভাষা। আজকে আমরা বাংলা ভাষার যে আধুনিকায়ন দেখতে পাই, হাজার বছর আগে এর রূপ এমন না থাকলেও বাংলা ভাষা ছিল। বিভিন্ন পুঁথিতে আমরা তার কিছুটা সন্ধান পাই। অতি প্রাচীন ভাষা হওয়াতে বাংলা ভাষার উৎপত্তি নিয়ে বিভিন্ন গবেষকের মতও ভিন্ন। সন তারিখ নিয়ে গবেষকদের মতের ভিন্নতা থাকলেও উৎপত্তির উৎস প্রায় একই। যেহেতু বাংলা এখন বিশ্বের প্রভাবশালী ভাষা, সুতরাং এই ভাষার উৎপত্তি সম্পর্কে খানিকটা ধারণা থাকা দরকার। এমন তো নয় যে পৃথিবী সৃষ্টির সাথে সাথেই বাংলা ভাষারও প্রচলন শুরু হয়েছিল। তবে একথা বলতে পারি যে বাংলা সরাসরি সৃষ্টি হওয়া কোনো ভাষা নয়। বিভিন্ন ভাষার সংমিশ্রণে বাংলা ভাষার উৎপত্তি। এর মধ্যে সংস্কৃত এবং পালি অন্যতম। লক্ষণীয় বিষয় যে সংস্কৃত ভাষা এখন বিলুপ্তির পথে। ভারতে মাত্র দশ হাজার মানুষ এখন সংস্কৃত ভাষায় কথা বলে। পালি ভাষার কোনো ব্যবহার কোথাও আছে কিনা আমার জানা নেই।
বাংলা ভাষা খুঁজে পাওয়া যায় খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ অব্দে ইন্দো ইউরোপীয় ভাষা গোত্রে। সরাসরি সংস্কৃত ভাষা থেকে উৎপত্তির কিংবদন্তি থাকলেও বাংলা ভাষাবিদরা বিশ্বাস করেন, বাংলা মাগধী প্রাকৃত এবং পালির মতো ইন্দো-আর্য ভাষা থেকে এসেছে।
ইন্দো-আর্য হলো ইন্দো-ইরানীয় ভাষা উপবিভাগের একটি প্রধান শাখা, যা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা গোত্রের পূর্বাঞ্চলীয় ধরন। প্রখ্যাত ভাষাবিদ সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, বৈদিক এবং সংস্কৃত উপভাষাগুলোকে প্রাচীন ইন্দো-আর্য যুগের প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। মধ্য ইন্দো-আর্য ভাষাগুলোর মধ্যে আছে পালিসহ প্রাকৃতের বিভিন্ন রূপ, যেগুলো পাওয়া যায় সম্রাট অশোক এবং থেরবাদ বৌদ্ধ কাননের শিলালিপিতে।
প্রথম সহস্রাব্দে বাংলা যখন মগধ রাজ্যের অংশ ছিল তখন মধ্য ইন্দো-আর্য উপভাষাগুলোর বেশ প্রভাব ছিল বাংলায়। এই উপভাষাগুলো মাগধী প্রাকৃত নামে পরিচিত আর এটিই ছিল আধুনিক বাংলা, বিহার ও আসামের লোকদের কথ্য ভাষা। এই ভাষারই বিবর্তিত রূপ অর্ধ-মাগধী প্রাকৃত, যেখান থেকে প্রথম সহস্রাব্দের শেষের দিকে উদ্ভব হয় অপভ্রংশের। অত:পর কালক্রমে এই অপভ্রংশ থেকে একটি স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে জন্ম হয় বাংলা ভাষার।
বাংলা ভাষার উৎপত্তি সম্পর্কে সাধারণ ধারণা লাভের পর আমরা জেনে নিতে পারি এই ভাষার বিবর্তন কীভাবে হলো। বাংলা ভাষার উৎপত্তি হওয়ার পর তা একটি জায়গায় থেমে থাকেনি। বিবর্তিত হতে হতে আজকের এই আধুনিক রূপ লাভ করেছে। আজ আমরা যে বাংলা ভাষা ব্যবহার করছি, শুরুতে কিন্তু এই ভাষা এতটা সমৃদ্ধশালী ছিল না। বাংলা ভাষার শুরুটা যদি আমরা দেখি তাহলে বিশ্বাসই হবে না যে এটি আমাদের বাংলা ভাষা। আমরা সেগুলো পড়তেও পারব না, লিখতেও পারব না।
বাংলা ভাষার বিবর্তনের তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে। পুরাতন, মধ্য এবং আধুনিক বাংলা। পুরাতন বাংলা ছিল ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে বাংলার পুরোহিত এবং পণ্ডিতদের সাহিত্যের ভাষা। এই সময়ের খুব কম চিহ্নই এখন অবশিষ্ট আছে। সবচেয়ে প্রাচীনতম নিদর্শনের মধ্যে একমাত্র চর্যাপদ পাওয়া যায়। এটি বৌদ্ধ ধর্মের ওপর ভিত্তি করে কবিতার একটি সংকলন যা অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে লিপিবদ্ধ হয়েছে বলে বিবেচনা করা হয়। চতুর্দশ শতকে বাংলায় শুরু হয় মুসলমানদের সালতানাত। সালতানাত বাংলাকে এই অঞ্চলের সরকারী দরবারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করে। এই ধারাবাহিকতায় ক্রমেই বাংলার স্থানীয় ভাষায় পরিণত হয় বাংলা।
ষোড়শ শতকে মুঘলরা বাংলা দখল করলে বাংলা ভাষার সাথে যোগসাজশ ঘটে ফার্সি ভাষার। বর্তমান বাংলা ভাষার আধুনিক রূপটি পাওয়া যায় ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের সময় বাংলার নদীয়া অঞ্চলে কথিত উপভাষায়। এই ভাষার দুটি ভাগ। শুদ্ধ ও চলিত। এগুলোর ভিত্তি গড়েছে প্রধানত মাগধী প্রাকৃত এবং পালিসহ তুর্কি, পর্তুগিজ, ফার্সি ও ইংরেজি।
১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত বাংলাকে সরকারি ভাষা করার দাবিতে বাংলা ভাষা আন্দোলন পূর্ব বাংলায় বাঙালি জাতীয়তাবাদকে লালন করে। ফলে ১৯৭১ এ নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের পর অভ্যুদয় ঘটে বাংলাদেশের। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো ভাষা আন্দোলনের স্বীকৃতিস্বরূপ ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। উনিশ শতকের শেষ এবং বিশ শতকের গোড়ার দিকে বাংলার প্রমিতকরণের সময় বাংলার সাংস্কিৃতিক কেন্দ্র ছিল ব্রিটিশ অধীন কলকাতা শহর। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ উভয় ক্ষেত্রেই যেটি প্রমিত রূপ হিসেবে গৃহীত হয়েছে, তা মূলত নদীয়া জেলার পশ্চিম-মধ্য উপভাষার উপর ভিত্তি করে।
প্রায় ১৩০০ বছরের দীর্ঘ বিবর্তনে বাংলা ভাষার সাথে যুক্ত হয়েছে প্রচুর পরিমাণে দেশীয় এবং বিদেশি শব্দ। বহু শতাব্দীর পর ১৯ শতকে এসে রাজা রাম মোহন রায় ও বিদ্যাসাগরের হাতে বাংলা চূড়ান্ত রূপ পায়। বাংলা ভাষা এখন আর বাংলাদেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এর বিশ্বায়ন ঘটেছে অনেক বছর আগে থেকেই। খানিকটা দেখে নেওয়া যাক বাংলাদেশের বাইরে বাংলা ভাষার পত্তন কতটা হয়েছে এবং বহির্বিশ্বে বাংলা ভাষা কতটা আধিপত্য বিস্তার করতে পেরেছে। এক কথায় বলতে গেলে ২১ শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার মর্যাদা লাভ করার পরই বিশ্বব্যাপী বাংলা ভাষার দোর্দণ্ড প্রতাপ থাকার কথা কিন্তু সম্পদের সীমাবদ্ধতা, বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবনে অক্ষমতা, আমলাতান্ত্রিক লাল ফিতার দৌরাত্ব, ঘুষ, দুর্নীতিকে জাতীয়করনের ফলে বিশ্বব্যাপী বাংলা ভাষা একক ছড়ি ঘোরানোর সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তা হয়ে ওঠেনি। মাতৃভাষা আদায়ের জন্য আত্মাহুতির ঘটনা বিশ্বে দ্বিতীয়টি নেই। শুধু এই সম্বলটুকু পুঁজি করেই আমরা বিশ্বে এক মহান জাতির মর্যাদা লাভ করতে পারি। কিন্তু আমরা তা না করে আমাদের মহান অর্জনগুলো কীভাবে ভুলুন্ঠিত করা যায় সে কাজে ব্যস্ত আছি। তারপরও বহির্বিশ্বে বাংলা ভাষা কতটা স্থান করতে পেরেছে তার সামান্য উদাহরণ দেওয়া যাক।
বাংলার বাইরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা, আসাম, বিহারসহ আরও কয়েকটি প্রদেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম বাংলা। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্য, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, জাপান, মালয়েশিয়া এবং ইউরোপের প্রায় সব দেশে যে অসংখ্য বাংলাভাষী বসবাস করেন, তাঁরাও নিজ উদ্যোগে বাংলা ভাষার চর্চা, গবেষণা ও প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান ও কানাডা থেকে বাংলা ভাষায় বর্তমানে একাধিক সংবাদপত্র প্রকাশিত হচ্ছে, টেলিভিশন-বেতার চ্যানেলে বাংলা ভাষার অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হচ্ছে। বিভিন্ন দেশের বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখানো হচ্ছে বাংলা ভাষা। বাংলা ও বাঙালি সংস্কৃতির চর্চা হচ্ছে মন্ট্রিয়ল, নিউইয়র্ক, টরেন্টো, সিডনি, মেলবোর্ন, টোকিও, ওসাকা, বেইজিং, সিঙ্গাপুর, লস অ্যাঞ্জেলেসসহ বিশ্বের বহু নগরীতে। ইউরোপ ও আফ্রিকার একাধিক দেশে মোতায়েন জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে দায়িত্ব পালন করছেন বাংলাদেশের সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীরা। ফলে সেখানেও নানাভাবে বাংলা ভাষার চর্চা হচ্ছে। সিয়েরা লিয়নে কিছুদিন আগে বাংলা ভাষাকে দ্বিতীয় ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। এভাবে বাংলা ভাষা ক্রমান্বয়ে বিশ্ব ভাষা প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশের বাইরে সবচেয়ে বেশি বাংলা চর্চা হয় ইউরোপ ও আমেরিকায়। এ দুই মহাদেশে একাধিক নজরুল ও রবীন্দ্র সেন্টার রয়েছে। ইংল্যাণ্ডের ইস্ট লণ্ডন, ম্যানচেস্টার ও বার্মিংহামে অসংখ্য বাংলাভাষীর বাস। সেখানকার সরকারি বিদ্যালয়গুলোতে বাংলা শেখা ও চর্চার সুযোগ রয়েছে। ইংল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষায় গবেষণাকর্ম পরিচালিত হয়, দেখতে পাওয়া যায় নানা ধরনের প্রকাশনা। মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই লন্ডনের সোয়াস নামের শিক্ষায়তনে প্রাচ্যবিদ্যা ও ভাষাচর্চা বিভাগে বাংলা ভাষার চর্চা হচ্ছে, চলছে গবেষণাও। যুক্তরাজ্যে বাংলা ভাষাকে গবেষণার বিষয় করেছেন জেডি এন্ডারসন, টি ডব্লিউ ক্লার্ক (কেমব্রিজ), জন বোল্টন, উইলিয়াম রাদিচে, হানারুথ থমসন প্রমুখ। তাদের কারোরই মাতৃভাষা বাংলা নয়। হানারুথ থমসন সোয়াসে বাংলার শিক্ষক ছিলেন, ইংরেজিতে বাংলা ভাষার একটি ব্যাকরণও লিখেছেন তিনি। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অদিতি লাহিড়ি বাংলা রূপতত্ত্ব ও ধ্বনিতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করছেন কয়েক দশক ধরে। এছাড়া সেখানে সিলেটি নাগরি লিপি নিয়ে কাজ করছেন জেমস লয়েড দম্পতি ও রজার গোয়েন।
যুক্তরাজ্যেও পর বাংলাচর্চা ও গবেষণার অন্যতম স্থান হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে কমপক্ষে ১০ টি বিশ্ববিদ্যালয় ও এশীয় গবেষণাকেন্দ্রে বাংলা ভাষার চর্চা হচ্ছে, যার মধ্যে নিউইয়র্ক, ইথাকা, শিকাগো, মিনেসোটা, ফ্লোরিডা, মেরিল্যান্ড, ক্যালিফোর্নিয়া, ভার্জিনিয়া, উইলকিনসন, হার্ভার্ড উল্লেখযোগ্য। যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার অর্থ প্রকাশে মনস্তত্ত্বের ভূমিকা নিয়ে কাজ করছেন জাস্টিন আলফানসো চাকোন। ওয়াশিংটনে বাংলাদেশি বংশদ্ভূত রাশাদ আহমেদ গবেষণা করছেন বাংলা অপশব্দ বা ‘স্ল্যাং’ নিয়ে। নিউইয়র্কে মারিয়া হেলেন বেরো কাজ করেন নজরুল সাহিত্য নিয়ে। এ বিষয়ে তাঁর একটি বইও প্রকাশিত হয়েছে।
বাংলা ভাষা শিক্ষাদান ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রে গবেষণা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, লালন, চর্যাপদ ও মধ্যযুগের সাহিত্য নিয়ে। যেসব গবেষক এ কাজে জড়িত ছিলেন এবং আছেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হচ্ছেন ক্লিন্টন বু থ সিলিচ্যানল ভন বমার, রাফল নিকোলাস, ডেভিড কফ ব্যাচেলবাওয়া, ক্যারল সলোমন, রিকি সলোমন, উইন্সটন ল্যানলি, ক্যারোলিন রাইট, হেনরিগ্রাসি, কেলম্যান, এন্ড্রু সিম্পসন, আন ডেভিড প্রমুখ। তাঁদের মধ্যে ক্লিন্টন বু থ সিলি কবি জীবনানন্দ দাশের সাহিত্য নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। এন্ড্রু সিম্পসন দক্ষিণ কালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করেন। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী বংশদ্ভুত দুই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সলিম-উদ-দৌলা খান ও ভারতের ইন্দ্রনীল দত্ত উচ্চতর গবেষণা করেছেন বাংলা ধ্বনি নিয়ে। কানাডায় প্রয়াত অধ্যাপক জোসেফ ওকনেল, ভ্যাংকুভারে ব্যারি মরিসন বাংলা ভাষার অধ্যাপনা ও গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। মন্ট্রিয়ল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাজেন্দ্র সিংহের তত্ত্বাবধানে বাংলা শব্দ গঠন বিষয়ে গবেষণা হয়েছে সেই ২০০৭ সালে। রাজেন্দ্র সিংহ সম্পাদিত সাউথ এশিয়ান জার্নাল অব ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যাণ্ড লিঙ্গুইস্টিকস শিরোনামের গবেষণামূলক পত্রিকায় বাংলা ভাষা নিয়ে নিয়মিত প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে ২০১২ সাল পর্যন্ত। কানাডার টরেন্টো ও মন্ট্রিয়ল থেকে বেশ কয়েকটি বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়ে থাকে, যার মধ্যে রয়েছে বাংলা কাগজ। টরেন্টো ভিক্টোরিয়া পার্ক-ড্যানফোর্থ এলাকায় গড়ে উঠেছে বাঙালি পাড়া। টরেন্টোতে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয় বাংলা।
বহির্বিশ্বে বাংলা ভাষা চর্চার বিষয়ে রাশিয়া এবং জাপানের কথা না লিখলেই নয়। ১৯৯৭ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত আমি বাংলা একাডেমি আয়োজিত তরুণ লেখক প্রকল্পে অংশ গ্রহণ করি। সেই সময় মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রফেসর আমাদের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন। তিনি সাবলীলভাবে বাংলা বলতে পারতেন। তিনি মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় পড়াশোনা করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে দুটি বৃত্তির অফার নিয়ে এসেছিলেন। আমাদের কোর্স কোঅর্ডিনেটর জনাব সিরাজ উদ্দিন আমাকে একটি বৃত্তি নিয়ে দুই বছরের জন্য মস্কো গিয়ে বাংলায় পড়াশোনা করার অফার দিয়েছিলেন। সে সময় পারিবারিক কারণে দুই বছর বিদেশে থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব হওয়ায় আমি বিনয়ের সাথে না বলি। সেই সময় টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের একজন প্রফেসর এসেছিলেন। তিনিও চমৎকার বাংলা বলতে পারতেন। আজও তাঁর নামটা আমার মনে আছে। অধ্যাপক সুয়োশিনারা। সম্প্রতি তিনি প্রয়াত হয়েছেন। জাপানে কতটুকু বাংলা ভাষা চর্চা হচ্ছে তার একটু আলোকপাত করে আমরা জাতিসংঘের দিকে নজর দেব। বাংলা ভাষা নিয়ে কী ভাবছে জাতিসংঘ?
জাপান, চীন, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় বাংলা ভাষা নিয়ে গবেষণা ও চর্চা হচ্ছে। তবে এ বিষয়ে অগ্রণী নি:সন্দেহে জাপান আর চীন। জাপানে প্রায় ৭০ বছর আগে কাজুয়ো আজুমা রবীন্দ্রপ্রেম থেকে বাংলা ভাষার চর্চা শুরু করেছিলেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চা করে তাঁর সারা জীবন কেটে গেছে। কেই শিরাই, অধ্যাপক নারা (সম্প্রতি প্রয়াত), কাজুহিরো ওয়াতানাবে, কিউকা নিওয়া, তোগাওয়া মাসিকোসহ বেশ কয়েকজন গবেষক জাপান ফাউন্ডেশন ও টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ও শিক্ষকতা করেছেন, করছেন। টোকিও ইউনিভার্সিটি অব ফরেন স্টাডিজে বাংলা ভাষা শেখানো শুরু হয়েছে পাঁচ বছর আগে। বর্তমানে এই বিভাগে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩০ জন। সেখানে পাঠদান করছেন কিউকা নিওয়া, কাজুহিরো ওয়াতানাবে, মনজুরুল হক প্রমুখ। আর কিয়োতো ও ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে বাংলা ভাষা শিক্ষা দিচ্ছেন বাংলা ভাষার তরুণ গবেষক হুজিয়ারা। বাংলাদেশের চাক ভাষাও তাঁর গবেষণার বিষয় এবং এই ভাষায় তিনি একটি অভিধান রচনা করেছিন। এছাড়া গিফু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিদিক মাকি বাংলা ও জাপানি ভাষার বাক্য গঠন নিয়ে তুলনামূলক গবেষণা করেছেন। রেডিও এনএইচকেতেও কাজুহিরো ওয়াতানাবের নেতৃত্বে বাংলা ভাষা শিক্ষাসহ নিয়মিত বাংলা অনুষ্ঠান হচ্ছে।
জাতিসংঘে আমাদের বাংলা ভাষার বর্তমান অবস্থান এক নজর দেখা যাক।
জাতিসংঘের ছয়টি দাপ্তরিক ভাষা রয়েছেÑ ইংরেজি, ফরাসি, রুশ, স্প্যানিশ, চীনা এবং আরবি। বাংলা এই ভাষাগুলোর মধ্যে একটি নয়। বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা করার জন্য বাংলাদেশ সরকার দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘে বাংলা ভাষার দাবিকে সমর্থন করার জন্য অন্যান্য দেশগুলোর সাথে যোগাযোগ করছে।
জাতিসংঘে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি পেলে এর অনেক সুবিধা হবে। এটি বিশ্বব্যাপী বাংলা ভাষার মর্যাদা বাড়াবে এবং বাংলাভাষী মানুষের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে যোগাযোগ করা সহজ হবে।
যিনি সর্বপ্রথম বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ নেন তিনি হলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর থেকে বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা করার জন্য কাজ শুরু করেন। ১৯৭২ সালে তিনি জাতিসংঘের মহাসচিব উথান্টকে একটি চিঠি লেখেন এবং বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা করার জন্য একটি প্রস্তাব উত্থাপন করার অনুরোধ জানান।
১৯৭৩ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা করার জন্য একটি প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। প্রস্তাবটি বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা এবং নেপালসহ ১৪ টি দেশের সমর্থন পায়। বঙ্গবন্ধু প্রথম ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ২৯ তম অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দেন।
বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা করার জন্য বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো অর্থের অভাব। জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষার স্বীকৃতি পেতে হলে একটি দেশকে অবশ্যই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রভাবশালী হতে হবে। বাংলাদেশ একটি ছোট দেশ এবং আন্তর্জাতিক প্রভাব সীমিত। বাংলা ভাষার জন্য জাতিসংঘের সভাগুলোতে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো এবং দক্ষতা তৈরি করা ব্যয়বহুল। বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা করার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে হবে। বাংলাদেশ সরকার যদি এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে পারে, তাহলে বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা করার সম্ভাবনা রয়েছে।
বিশে^র ৭ম সৌন্দর্যমণ্ডিত শহর লস অ্যাঞ্জেলেসে বাস করছি গত ২২ বছর ধরে। বর্তমানে এটি বিশে^র অন্যতম ব্যয়বহুল শহরে পরিণত হয়েছে। দৈনন্দিন জীবনের খরচ বহন করতে না পেরে অনেকে এই শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। অনেকে আবার ফিরেও আসছেন। এই শহরের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো চমৎকার আবহাওয়া। গোটা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে লসঅ্যাঞ্জেলেস বসবাসের জন্য অন্যতম সেরা। এই শহরকে চির বসন্তের শহর বলা যায় এবং এর নৈসর্গিক সৌন্দর্য যে কাউকে আকর্ষণ করে। তাই জীবন যাপনের খরচ যতই বেশি হোক, খুব সহসা এই শহর কেউ পরিত্যাগ করে না।
লসঅ্যাঞ্জেলেস এমন একটি আন্তর্জাতিক শহর যেখানে ২৩৫টি দেশের মানুষ বাস করে এবং এরা ২২৪টি ভাষায় কথা বলে। রাষ্ট্রভাষা ইংরেজি। স্প্যানিশ হলো দ্বিতীয় রাষ্ট্রীয় ভাষা। এর পর কোন দেশের কতজন মানুষ বাস করে এবং কে কোন ভাষায় কথা বলে তা নির্ণয় করা সম্ভব না। তবে বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকায় কোরিয়ান ভাষা তৃতীয় হিসেবে পরিগণিত হয়। এরপর আমাদের পরিচিত ভাষার মধ্যে হিন্দি, উর্দু, আরবি, চায়নিজ, জাপানি, থাই, জার্মান এগুলো রয়েছে বলে মনে হয়। বাকি ভাষাগুলো সম্পর্কে আমার ধারণা নেই। তবে একজন বাংলাদেশি হিসেবে দুঃখ প্রকাশ করে বলতে হয় এখানে বাংলাকে সবচেয়ে অবহেলিত ভাষা বলে মনে হয়। কারণ আমাদের সমসাময়িকরা অনর্গল বাংলা ভাষা ব্যবহার করলেও নতুন প্রজন্ম বাংলা ভাষা ব্যবহারে একেবারেই অনভ্যস্ত। এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাও এমনই যে ইংরেজি ছাড়া অন্য কোনো ভাষাকেই গুরুত্ব দেওয়া হয় না। ক্ষেত্র বিশেষে বাংলা ভাষা নিয়ে গবেষণা বা অন্যকিছু করার সুযোগ খুবই সীমিত। ইতোমধ্যে অবশ্য সিটি অব লসঅ্যাঞ্জেলেস ভোটের ব্যালট পেপার এবং নিয়মাবলীগুলো বাংলা ভাষায় ছাপাতে শুরু করেছে। লসঅ্যাঞ্জেলেস থেকে প্রায় ৭০ মাইল দূরে সিটি অব প্যারিস সরকারি অর্থায়নে স্থায়ী শহীদ মিনার বানিয়ে দিয়ে বাংলা ভাষার প্রতি অসীম শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছে। লসঅ্যাঞ্জেলেস প্রবাসী বাংলাদেশিদের অক্লান্ত পরিশ্রমে ২০১০ সালে বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকায় সামান্য কিছু এলাকাকে ‘লিটল বাংলাদেশ’ (খরঃঃষব ইধহমষধফবংয) এলাকা হিসেবে সরকারিভাবে ঘোষণা করেছে। যে কারণে স্বল্প পরিসরে হলেও লসঅ্যাঞ্জেলেসে বাংলাদেশিদের একটা দাপট আছে। এ ছাড়াও প্রতি বছর সিটি অব লসঅ্যাঞ্জেলেস লোটাস ফেস্টিভ্যাল (খড়ঃঁং ঋবংঃরাধষ) আয়োজন করে এবং বহু ভাষাভাষির মধ্যে বাংলাদেশও যোগদান করতে পারে। আমাকেসহ বেশ কয়েকজন বাংলাদেশিকে তারা সম্মাননা পত্র দিয়েছে। এ সব কিছু অর্জনের এসমাত্র উৎস হচ্ছে ভাষা।
বাংলা ভাষা বিশ্বের সেরা মধুর ভাষা এবং ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে পুঁজি করে বিশ্বে আমরা একটি মহান জাতি হিসেবে সম্মানিত হওয়ার সুযোগ থাকলেও বাংলাদেশ মিশনগুলো এ ব্যাপারে সামান্যতম পদক্ষেপ গ্রহণ করে না। শুধু সরকার থেকে পাঠানো কয়েকটি বাণী পাঠ আর প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য দামি খাবার বিতরণের মধ্যে তাদের কার্যক্রম সীমিত থাকে। বহির্বিশ্বে বাংলা প্রচার ও প্রসারে সরকারি উদ্যোগের একটি খবরও জানা যায় না। বর্তমানে বিশ্বের ৫০টি দেশে বাংলাদেশের ৮১ টি কুটনৈতিক মিশন চালু আছে। সেই মিশনের কর্মকর্তারা চাইলে সংশ্লিষ্ট দেশে বাংলা ভাষার ব্যাপক পরিচিতি লাভ করাতে পারেন। বিশেষ করে ২১ শে ফেব্রুয়ারি সংশ্লিষ্ট দেশে বাংলা ভাষার তাৎপর্য তুলে ধরে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করতে পারেন। সংশ্লিষ্ট দেশের ভাষাবিদদের নিয়ে টেলিভিশনে আলোচনা করতে পারেন। স্থানীয় স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে ভাষাভিত্তিক অনুষ্ঠান করে বাংলা ভাষাকে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করাতে পারেন। কুটনৈতিক মিশনগুলো ফ্রি বাংলা ভাষা প্রশিক্ষণ কোর্স বা সামান্য বৃত্তি প্রদানের মাধ্যমে বাংলা প্রসারের ব্যবস্থা নিতে পারে। অন্যদিকে বাংলাদেশে ৫২ টি দেশের দূতাবাস রয়েছে। এসব দূতাবাসের কর্মকর্তা কর্মচারিদের ফ্রি বাংলা ভাষা প্রশিক্ষণ দিয়ে একদিকে যেমন বাংলা ভাষার প্রসার ঘটানো সম্ভব অন্যদিকে বাংলাদেশে তাদের কাজ করা অনেক সহজ হবে। তবে এই কাজটি সরকারকেই করতে হবে। ব্যক্তি উদ্যোগে বা কোনো সংগঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশে এটা করা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাসই ভাষা কেন্দ্রীক। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাংলা ভাষার চেতনা থেকে জন্ম নেয় এবং একটি স্বাধীন জাতির আবির্ভাব ঘটে। সুতরাং আমাদের মাথায় রাখতে হবে বাংলা ভাষাকে কোনোভাবে অবজ্ঞা করা মানে আমাদের পুরো জাতির জন্ম ইতিহাসকেই অবজ্ঞা করা। বাংলা ভাষাকে আমরা যত সম্মান দেখাতে পারব, ততই সম্মানিত হব। এর জন্ম ইতিহাস অন্তত সে সাক্ষতই দেয়।
(লেখক: লসএঞ্জেলেস প্রবাসী সাংবাদিক ও লেখক)
Posted ৯:০৯ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
nyvoice24 | New York Voice 24