ভাষা-আন্দোলন ও বইমেলা

ফারুক আহম্মেদ জীবন   প্রিন্ট
রবিবার, ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫   সর্বশেষ আপডেট : ৯:৩৭ পূর্বাহ্ণ

ভাষা-আন্দোলন ও বইমেলা

সকাল এগারোটা বাজে। রত্না ওয়াশরুম থেকে গা-গোসল সেরে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এলো। খুব তড়িঘড়ি করে গোছাচ্ছে ও বই মেলায় যাবে বলে। এবছর ওর লেখা ১-টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ হয়েছে।

বইয়ের নাম “রক্তাক্ত ভাষা”। বেশ সুন্দর লেখার হাত রত্মার। যদিও রত্মা কলেজ পড়ুয়া উঠতি বয়সী এক ফুটন্ত তরুণী। ওর এখন যে বয়স। এ বয়সে অবশ্য ওর লেখার কথা প্রেম ভালোবাসার রসের কবিতা। যে কবিতার মধ্যে আকর্ষণীয় সব পংক্তি থাকবে। থাকবে হাস-রস রোমান্টিকতা। প্রেম ভালোবাসার নানান রসালো সব ছন্দ মালা।

যা- পড়লে অজানা এক অনুভূতিতে দেহ শিহরিত হয়ে উঠবে।কিন্তু তা- না,তার কাব্য-কবিতার মাঝে বেশিরভাগই দেশ প্রেম ফুটে ওঠে। আর উঠবেই বা- না কেনো? তার শরীরে যে বয়ে চলেছে নিখুঁত এক দেশ-প্রেমিকের রক্ত । কেননা…রত্নার দাদা রহিম মিয়া ছিলেন ১৯৫২ সালের একজন ভাষা আন্দোলনের একনিষ্ঠ সৈনিক।আর রত্নার আব্বা রফিকুল মিয়া ছিলেন ১৯৭১ সালের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।
“ঐ- যে কথায় আছে না…
রক্তে কথা কয়,
সেটাই হয়েছে ঠিক যেনো রত্নার বেলায়”
রত্না ইতিহাসের উপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবছর অনার্স শেষ বর্ষে অধ্যায়ন করছে। কুকিং রুমে রান্না করছিল রত্নার মা রুপালী বেগম। রত্না গোছাতে গোছাতে একবার বললো…আম্মু রান্না কি হয়েছে?

আমার যে দেরি হয়ে যাচ্ছে। রুপালি বললো হয়ে গেছে মা রত্না। রেডি হয়ে স্বপ্নাকে ডেকে ডাইনিং টেবিলে বস। আমি এখুনি খাবার নিয়ে আনছি। রত্না কয়েকবার স্বপ্নাকে একটু জোরে ডাকলো। স্বপ্ন..এই স্বপ্না..স্বপ্না খেতে আয়।রত্মার ছোট বোন স্বপ্ন, সে নিজের ঘরে খোলা জানালার কাছে বসে বাইরের দিকে আনমনা হয়ে তাকিয়ে আছে। স্বপ্নার আনমনা হয়ে বসে থাকারও অবশ্য কারণ আছে…।

এই ফেব্রুয়ারী মাস-টা আসলেই আজো স্বপ্নার বুকের ভিতর-টাতে কেমন যেনো মোচড় দিয়ে ব্যথা করে উঠে। কলিজাতে তীব্র রক্ত ছোটে তার। যদিও সে বয়সের দিক থেকে এখনো কিশোরী। কেবল অষ্টম শ্রেণীতে পড়ছে। বয়স বারো- তেরো- হবে। তবুও তার দাদুর কাছে শোনা। সেদিনের সে ভাষা আন্দোলনের গল্পের কথা আজো ভুলতে পারিনি। দাগ কেটে আছে স্বপ্নার মনে। স্বপ্নার দাদু রহিম মিয়া যদিও আজ বেঁচে নেই। কিন্তু দাদুর বলা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সেই গল্প আজো তার মনে আছে। সে কল্পনায় ডুবে ভাবতে লাগলো… তখন স্বপ্না কেজি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে। ফেব্রুয়ারী মাসের বইমেলার এমনি একদিন স্বপ্না ওর মা-বাবা বোনের সাথে অমর ২১শের বইমেলায় যাবে বলে তৈরি হচ্ছিল। স্বপ্নার দাদু বললো কি দাদু ভাই বইমেলায় যাচ্ছ? উত্তরে স্বপ্ন বললো হুম দাদু, বইমেলায় যাচ্ছি। অনেক মজা করব দাদু। ফুল, পাখি, সাগর, আকাশ, চাঁদ, সূর্য নদীনালা, পাহাড় রঙিন প্রজাপতি আঁকা নানান রকম মজার ছড়ার বই কিনবো। ভালো হবে না দাদু? রহিম মিয়া হেসে ওঠে বললো…হুম খুব ভালো হবে দাদু।

সাথে কিন্তু আমাদের দেশ, দেশের মানুষ, মাটি, সবুজ ফসলের মাঠ, ভাষা-আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এসব ছবি আছে। এসব নিয়ে লেখা ছড়া কবিতা আছে। সেসব বইও কিনে এনো কেমন দাদু ভাই? স্বপ্নার ছোট মনে প্রশ্ন জেগেছিল। তাই সে দাদুর দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো কেনো দাদু? উত্তরে রহিম মিয়া বললো: ওসব ছবি আঁকা। আর ঐসব বিষয় নিয়ে এখন থেকে তুমি না পড়লে। এদেশ, এ দেশের মানুষ, এ দেশের মাটির প্রতি ভক্তি প্রেম ভালোবাসা মমতাবোধ জন্মাবে কিভাবে?

তুমি আজকের যে অমর ২১শে বইমেলায় যাচ্ছ। জানো দাদু…এই বাংলা ভাষার প্রাণ বর্ণমালা স্বরবর্ণ অ, আ, ই, ঈ, ব্যঞ্জনবর্ণ ক, খ, গ, ঘ, এই
বর্ণমালা গুলোকে টিকিয়ে রাখতে রফিক, শফিক, সালাম, জব্বার, বরকতের মতো কতো নওজোয়ান জীবন দিয়েছে ১৯৫২ সালে।সেদিনের সে মিছিলে আমি হয়তো বেঁচে গিয়েছিলাম। কিন্তুএকটা পা- হারিয়ে ছিলাম খান সৈন্যদের ছুঁড়া বুলেটের আঘাতে। আজো ভয়াবহ সে দিনটির কথা মনে পড়লে শিহরিত হয়ে উঠি। উহু! কতো রক্ত, কতো গুলিবিদ্ধ মানুষের আহাজারি।

কতো লাশ পড়েছিল রাজপথে। এরপর ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে এদেশ, মাটি থেকে শত্রু মুক্ত করতে লাখ-লাখ বাঙালী জীবন দিয়েছিল। সাত বীর শ্রেষ্ঠর নাম হয়তো শুনেছ দাদু। লেফটেন্যান্ট মতিউর, মোস্তফা কামাল, ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর, নুর মোহাম্মদ, রুহুল আমিন, মুন্সি আব্দুর রউফ, হামিদুর রহমান। এছাড়াও কনে-কতো যে লাশ পড়েছিল তার ইয়াত্বা নেই।সেই ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে তোমার আব্বুও গিয়েছিল। হয়তো তোমার আব্বু অক্ষত অবস্থায় বাড়ি ফিরে এসেছিল যুদ্ধ শেষে। কিন্তু কতো মা-বাবার বুক যে খালি হয়ে গিয়েছিল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে। তা- কি বলবো দাদু। ঐসব বীর সন্তানরা সেদিন যদি ভাষার জন্য আন্দোলন না করতো। এদেশের জন্য যুদ্ধ না করতো। তাহলে এদেশ স্বাধীন হতোনা। মাতৃভাষা বাংলাকেও হারিয়ে ফেলতাম।

আজকের এই বইমেলাও হতোনা। আজকের এই বইমেলা, বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য শিল্প সংস্কৃতি তাইতো ভাষা-আন্দোলন আর আমাদের
মুক্তিযুদ্ধের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ দাদু ভাই।

সেদিন স্বপ্না ওর দাদুর মুখে শুনেছিল কিভাবে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ১৯৫২ সালে পূর্ব বাংলার বাঙালীদের এই মাতৃভাষা বাংলা কেড়ে। বাঙালীদের উপর জোর করে ওদের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করতে চেয়েছিল। কিন্তুু বাঙালীরা তা- সেদিন মেনে নেয়নি। সে দিনটি ছিল বাংলা ১৩৫৮ বঙ্গাব্দের ৮-ই ফাল্গুন বৃহস্পতিবার। ইংরেজি ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী। সেদিন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর গড়া ১৪৪ ধারা কঠিন আইন ভঙ্গ করে। জীবনের পরোয় সবা না করে।

গর্জে উঠেছিল বাঙালী ছাত্র সমাজ থেকে শুরু করে শিক্ষক শ্রমিক কৃষক সকলেই।তারা শত্রুদের বন্দুকের নলের সামনে নির্ভীক অকুতোভয় মনে এগিয়ে গিয়েছিল মিছিল করতে করতে। তা-দেখে শত্রুরা নিরস্ত্র বাঙালীদের মিছিলের উপর এলো-পাতাড়ি গুলি ছুঁড়তে শুরু করে।তাদের ছুঁড়া তপ্ত ঝাঁঝালো বুলেটের সামনে নিরস্ত্র বাঙালীদের মুখে একটাই স্লোগান ছিল….
বাংলা আমার মায়ের ভাষা
রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই,
রাষ্ট্র ভাষা উর্দু আমরা মানি না….
মানবো না কেউ আমরা তাই।

রত্না আবার ডাকছে এই স্বপ্না…স্বপ্না এই খেতে আয়। হঠাৎ রত্নার ডাক কানে আসতেই সে সম্বিত ফিরে পেলো। উঠে খেতে গেল। রুপালী বললো
কিরে মা স্বপ্না তুই তোর আপুর সাথে বইমেলায় যাবি না? স্বপ্না বললো হুম যাবো আম্মু। রত্না বললো: গেলে খাওয়া শেষে দ্রুত গুছিয়ে নে স্বপ্ন।
স্বপ্ন বললো; আচ্ছা ঠিক আছে। তারপর খাওয়া শেষ করে রুমে গিয়ে দ্রুত গুছিয়ে ওর আপুর সাথে বইমেলায় গেলো। বইয়ের স্টলে পৌঁছাতেই
রত্নাকে সব পাঠক ভক্তরা ঘিরে ধরলো। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের ও মিডিয়ার সাংবাদিকও আছে।
বেশ পাঠক প্রিয়তা পেয়েছে রত্নার” রক্তাক্ত ভাষা” বইটি। অনেক পাঠকের হাতে রত্নার বই দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ এগিয়ে এসে অটোগ্রাফ চাচ্ছে রত্নার কাছে। সাংবাদিকরা রত্নার কাছে তার বই এর পাঠকপ্রিয়তা পাওয়া নিয়ে অনুভূতি জানতে চাইছে। রত্না আবেগপূর্ণ অনুভূতি ব্যক্ত করলো।

কথার মাঝে তার দাদু ও আব্বু আম্মুর কথাও তুলে ধরলো। বেশ আনন্দঘন এক মুহূর্ত কাটলো পাঠকদের সাথে বইমেলায় রত্না আর স্বপ্নার।
স্বপ্ন তার দাদুর কথা ভুলিনি।সে বিভিন্ন স্টলে ঘুরে ঘুরে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তি যুদ্ধের উপর লেখা বিভিন্ন কবি-লেখকদের বই কিনতে লাগলো। এক সময় সন্ধ্যা নামতেই ওরা দু,বোন সকলের কাছ থেকে হাসি মুখে বিদায় নিয়ে একটা গাড়ি ধরে বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলো।

Facebook Comments Box

Posted ৯:৩২ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

nyvoice24 |

.

Address
New York
Phone: 929-799-2884
Email: nyvoice24@gmail.com
Follow Us