নিউইয়র্ক বইমেলার বিশ্বজিৎ কেন ট্রেড ফেয়ার এবং রেমিটান্স মেলায়

বিশেষ সংবাদদাতা   প্রিন্ট
শুক্রবার, ২১ মার্চ ২০২৫   সর্বশেষ আপডেট : ৭:০৪ পূর্বাহ্ণ

নিউইয়র্ক বইমেলার বিশ্বজিৎ কেন ট্রেড ফেয়ার এবং রেমিটান্স মেলায়

সাবেক সরকারের আইসিটি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রি জুনাইদ আহমেদ পলকের বিশেষ সুপারভিশনে নিউইয়র্কে বিশ্বখ্যাত মেডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে ‘জয় বাংলা কনসার্ট’ এবং তারও আগে-পিছে সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন একটি বন্ড বাজারজাত করার অভিপ্রায়ে রাষ্ট্রীয় অর্থে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে রোড শো করা হয়েছে বিশাল আয়োজনে। এসব শো-তে মার্কিন কোন বিনিয়োগকারির দেখা মেলেনি। তবে বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ভূয়া কোম্পানী, আবাসন কোম্পানী ও নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের নামে যারা বিপুল অর্থ ঋণ হিসেবে নিয়েছেন তারা ছিলেন সরব। ঢাকা থেকে উড়ে এসে সালমান রহমান সন্তুষ্ট রাখার জন্যে কথিত সব রোড শো-তে অংশ নিয়েছেন। এমনকি, ডলারের সংকট তীব্র আকার ধারণকালেও অর্থাৎ ২০২৪ সালের ২৪ মে তারিখেও বাংলাদেশের ৩০ ব্যাংকের ৩০ জন এমডি, বাংলাদেশের শীর্ষ কর্মকর্তাগণের অংশগ্রহণে বড় ধরনের একটি রোড শো’র ঘোষণা দেয়া হয়। সেখানে ৪৫ জন কর্মকর্তা এসেছিলেন মূলত: বিনোদন ভ্রমণে। রোড শো, রেমিট্যান্স ফেয়ার, ট্রেড ফেয়ারের নামে গত ১৫ বছরে যুক্তরাষ্ট্রে যে সব সমাবেশ হয়েছে কোনটি থেকেই বাংলাদেশ লাভবান হয়নি। নেপথ্যে ছিল অর্থ পাচারের ফন্দি, সম্ভব হলে আদম পাচারের ঘটনাও ঘটেছে। কেউ মুখ খুলেননি বহুবিধ কারণে। যেমন জয় বাংলা কনসার্ট উপলক্ষে নিউইয়র্ক কন্স্যুলেটে জুনাইদ আহমেদ পলক আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকগণের সঠিক প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে মাঝে মধ্যেই ‘জয় ভাই’ উচ্চারণ করতেন। অর্থাৎ সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একমাত্র পুত্রের নাম ভাঙিয়েছেন। সংবাদ সম্মেলনে অত্যন্ত জোরেশোরে পলক অঙ্গিকার করেছিলেন যে, কনসার্টের আয়-ব্যয়ের তথ্য সপ্তাহখানেক পরই ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে জানানো হবে। সেটি ঘটেনি। অধিকন্তু নিউইয়র্ক থেকে এই সংবাদদাতা পলকের ফোনে যোগাযোগ করে তথ্য জানার চেষ্টা করেও সক্ষম হননি। কনসার্টের আবেগ পুঁজি করে সে সময় বেশ কয়েক মিলিয়ন ডলার পাচারের ঘটনা ঘটেছে বলে পরবর্তীতে কম্যুনিটিতে চাউড় হয়েছিল। সালমান এফ রহমানের কথিত রোড শো-র আড়ালে কত মিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে এবং ব্যাংক কর্মকর্তাসহ আমলা গ্রুপের যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণের নামে কত মিলিয়ন ডলারের অপচয় ঘটেছে সেটিও উদঘাটনের দাবি রাখে। এমনি অবস্থায় নিউইয়র্কের পুস্তক বিক্রেতা ‘মুক্তধারা’র কর্ণধার বিশ্বজিৎ সাহা বইমেলার পাশাপাশি ট্রেড শো এবং রেমিট্যান্স ফেয়ারেও ঝাঁপিয়ে পড়েন কয়েক বছর আগে । সে সব আয়োজনে জড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের বাণিজ্য, অর্থ মন্ত্রণালয়সহ গুরুত্ব কয়েকটি দফতর। রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরো আগের মত গতবছরও সরাসরি বাংলাদেশে বিজ্ঞপ্তি প্রচারও করেছে। এমনকি এফবিসিসিআইয়ের পক্ষ থেকেও ব্যবসায়ী-শিল্পপতিগণকে আহবান জানানো হয়েছে বিশ্বজিৎ সাহার ট্রেড ফেয়ার অথবা রেমিট্যান্স ফেয়ারে অংশগ্রহণের জন্যে। আগে নাম ভাঙিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণের দিন ঘিরে এবং গতবছর টেকনিক পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশ ইমিগ্র্যান্ট ডে অ্যান্ড ট্রেড ফেয়ার’ নাম দেয়া হয়েছিল। আর এসব কথিত আয়োজনের নেপথ্যে ছিল আদম পাচার, অর্থ পাচার এবং রাষ্ট্রীয় খরচে পদস্থ আমলাদের বিনোদন ভ্রমণ। কয়েকটি ব্যাংকের কর্মকর্তারা এসব ট্রেড ফেয়ারের স্পন্সরশীপের নামে মোটা অংকের বৈদেশিক মুদ্রা হাতিয়ে নিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। এই মেলায় ‘নতুন বাংলাদেশের বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ডঃ আহসান এইচ মনসুর’ আসছেন বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে আয়োজকদের পক্ষ থেকে। তার সাথে আছেন অন্য ব্যাংক কর্মকর্তাগণও। এই রেমিট্যান্স মেলার আয়োজক নিউইয়র্কের মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের বিশ্বজিৎ সাহা। ‘বাংলাদেশ-ইউএসএ চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি’ (বিইউসিআই) এবং ‘ইউএসএ বাংলাদেশ বিজনেস লিঙ্ক’র নামে আগামী ১৯ ও ২০ এপ্রিল নিউইয়র্কে চতুর্থ বাংলাদেশ রেমিট্যান্স মেলা অনুষ্ঠিত হবে বলে জানানো হয়েছে। জ্যাকসন হাইটসের সানাই রেস্টুরেন্টে এ আয়োজনের পুরোধা হিসেবে নাম রয়েছে: আহবায়ক ডা. জিয়াউদ্দিন আহমেদ, প্রেসিডেন্ট বিইউসিআই; ভাইস প্রেসিডেন্ট, বিইউসিআই; ও প্রধান সমন্বয়কারী- বিশ্বজিৎ সাহা, সিইও বিইউসিআই। আয়োজকবৃন্দ বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ও বেসরকারি খাতের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান নির্বাহীদের কাছে চিঠি লিখে গত তিনটি রেমিট্যান্স মেলায় যেসব আর্থিক প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করেছে, তাদের অ্যাওয়ার্ড প্রদানসহ আয়োজকদের বিভিন্ন কর্মতৎপরতার বাহারি বয়ান দিয়ে এবারের মেলায় আরো অধিকসংখ্যক প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণের সম্ভাবনার কথা জানায়।

রেমিট্যান্স ফেয়ারে স্টল দেয়ার আহবানে রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরোর সার্কুলার। ছবি-এনওয়াইভয়েস২৪।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর প্রধান অতিথি হিসেবে ‘বৈধ রেমিট্যান্স-উন্নত বাংলাদেশ’ শীর্ষক এই রেমিট্যান্স মেলা উদ্বোধন করবেন বলে চিঠিতে জানানো হয়। আয়োজকরা আরো নিশ্চিত করেছেন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর ১৮ এপ্রিল নিউইয়র্ক আসবেন। মেলায় বিশেষ অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করবেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ড. মোঃ হাবিবুর রহমান এবং পরিচালক মনোয়ার উদ্দীন আহমেদ, এফবিসিসিআইর প্রশাসক মোঃ হাফিজুর রহমান, সোনালী ব্যাংক পিএলসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্সের চেয়ারম্যান আব্দুল হাই সরকার, অগ্রণী ব্যাংক পিএলসির চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ, ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টু, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির চেয়ারম্যান ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ, এক্সিম ব্যাংক অব বাংলাদেশ পিএলসির চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম স্বপন, আইএফআইসি ব্যাংক পিএলসির চেয়ারম্যান মোঃ মেহমুদ হোসেন, পূবালী ব্যাংক পিএলসির চেয়ারম্যান মনজুরুর রহমান, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক পিএলসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুল আজিজ, এসবিএসি ব্যাংক পিএলসির চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মো. মোখলেসুর রহমান, মার্কেন্টাইল ব্যাংক পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মতিউল হাসান, পূবালী ব্যাংক পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী, এনআরবি ব্যাংক পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারেক রিয়াজ প্রমুখ। এছাড়া বাংলাদেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনেক ব্যক্তিবর্গ মেলায় উপস্থিত থাকবেন বলে জানানো হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মেলায় অংশগ্রহণ করবে। এর মধ্যে রয়েছে ব্যাংক, মোবাইল ব্যাংকিং, অ্যাপ ডেভলপার, মানি এক্সচেঞ্জ ও বিভিন্ন রেমিট্যান্স-চ্যানেল পার্টনার, মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, অফশোর ব্যাংকিংসেবা প্রদানকারী, মানি ট্রান্সফার এবং রেমিট্যান্স অ্যাপ, প্রবাসী ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাবৃন্দ।।

মেলায় এসব প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্য ও সেবার প্রদর্শনীর পাশাপাশি এনিয়ে বিভিন্ন সেমিনার সিম্পোজিয়াম, কিউ অ্যান্ড এ সেশন এবং নেটওয়ার্কিং ডিনার অনুষ্ঠিত হবে। মেলা আয়োজক কমিটি রেমিট্যান্স ফেয়ার এবং অফশোর ব্যাংকিং নিয়ে একটি বিশেষ প্রকাশনাও রাখছে। যেখানে লিখছেন খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ, অধ্যাপক, ব্যাংকার। আয়োজকরা আরো জানিয়েছেন যে, মেলায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানের স্টলে প্রবাসী বাংলাদেশিদের ব্যাংক একাউন্ট খোলার সুযোগ থাকবে। এর বাইরে নানারকম সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের আয়োজনও রয়েছে। এছাড়া নেটওয়ার্কিং সেশনে অংশ নেবেন নিউইয়র্ক ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস ডিপার্টমেন্ট এবং প্রধান প্রধান মানি একচেঞ্জ কোম্পানিসমূহ। যার মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপন এবং রেমিট্যান্স খাতের সর্বশেষ উদ্ভাবনসমূহ এখানে প্রদর্শিত হবে।

রেমিট্যান্স সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠানকে উৎসাহিত করতে গত বছরের মতো এবারও পুরস্কৃত করা হবে সেরা ১০ জন বাংলাদেশি-আমেরিকান রেমিট্যান্স প্রেরক, বাংলাদেশের শীর্ষ ৩ রেমিট্যান্স রিসিভার ব্যাংক, শীর্ষ ৩ মানিএক্সচেঞ্জ কোম্পানি বা রেমিট্যান্স চ্যানেল পার্টনারকে।

দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পাঠানো চিঠিতে রেমিট্যান্স মেলায় টাইটেল স্পন্সর (একজন) হিসেবে অংশগ্রহণ করতে হলে তাকে বাংলাদেশী মুদ্রায় ৫০ লাখ টাকা; পাওয়ার্ড বাই স্পন্সরের (একজন) জন্য ৩০ লাখ টাকা; চারজন প্রোগ্রাম স্পন্সর হিসেবে থাকবেন, যাদের প্রত্যেকেকে দিতে হবে ১২ লাখ টাকা করে।

জানা গেছে, বিগত সরকারের আমলে বিভিন্ন ব্যাংক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান মোটা অংকের অর্থ দিয়ে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে বিশ্বজিৎ সাহাকে। তারই ধারাবাহিকতা গত বছরও অনুষ্ঠিত হয়েছে বহুল আলোচিত সেই মেলা। মুক্তধারার বিশ্বজিৎ সাহা দীর্ঘ সাড়ে তিন দশক যাবত ‘মুক্তধারা বইমেলা’ করে আসছেন। এটি হচ্ছে তার পেশার সাথে সম্পর্কিত বিষয় এবং এর খ্যাতিও রয়েছে। এর বাইরে এসে কেন তিনি নামসর্বস্ব রেমিট্যান্স ফেয়ার অথবা ট্রেড ফেয়ার আয়োজনে নেমেছেন সে প্রশ্ন প্রবাসীদের। সচেতন প্রবাসী বাংলাদেশীরা ইতোমধ্যেই এই প্রচেষ্টা রুখে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। প্রবাসী বাংলাদেশীদের প্রশ্ন অন্তর্বর্তী সরকারের অভ্যন্তরে থেকে কারা এহেন লোক দেখানো কর্মকান্ডে সহযোগিতা করছে?

Facebook Comments Box

Posted ৮:০০ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ২১ মার্চ ২০২৫

nyvoice24 |

Address
New York
Phone: 929-799-2884
Email: nyvoice24@gmail.com
Follow Us