আমেরিকান স্বপ্ন পূরণে একজন শামসুল হকের প্রয়াস

নিজস্ব প্রতিবেদক   প্রিন্ট
বৃহস্পতিবার, ০৩ এপ্রিল ২০২৫   সর্বশেষ আপডেট : ৬:৩৭ পূর্বাহ্ণ

আমেরিকান স্বপ্ন পূরণে একজন শামসুল হকের প্রয়াস

এনওয়াইপিডিতে দীর্ঘ ক্যারিয়ার শেষে লেফট্যানেন্ট কমান্ডার হিসেবে ১ মার্চ অবসর নেয়া বাংলাদেশী আমেরিকান শামসুল হক বলেছেন, প্রতিটি দিন নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে, কিন্তু সেই সঙ্গে মূল্যবান শিক্ষা দিয়েছে ধৈর্য, সততা, এবং টিমওয়ার্কের শক্তি সম্পর্কে। আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ যে, আমি আইন শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে বিশ্বের অনন্য এক বাহিনীর সেরা সদস্যদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। বিভিন্ন ভাষা, বর্ণ ও অঞ্চলের অফিসারেরা আমাকে আপন করে নিতে ভুলেননি-যা অবশিষ্ট জীবনে আমার জন্যে অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। আর এভাবেই বহুজাতিক এই সিটি তথা আমেরিকার মানবিক-সামাজিক মূল্যবোধের প্রকাশ ঘটেছে সর্বস্তরে।
আমেরিকান স্বপ্ন পূরণের পথে যে কজন বাংলাদেশী নিজ যোগ্যতার বলে সাফল্যের উচ্চ আসন লাভ করতে সক্ষম হয়েছেন তার একজন হলেন সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার ১নং বাঘা ইউনিয়নের গৌরা বাড়ী গ্রামের মরহুম আাব্দুল মুছাব্বিরের পুত্র শামসুল হক।

দীর্ঘ একুশ বছর পুলিশ বিভাগে অত্যন্ত দক্ষতা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালনের মধ্যদিয়ে প্রকারান্তরে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী বাংলাদেশীদের ভাবমূর্তি তিনি উজ্জ্বল করেছেন। পরবর্তীতে আরো অনেকে এনওয়াইপিডিতে যোগদানে অনুপ্রাণীত হয়েছেন। শামসুল হকের বীরত্ব অন্যদেরকে উজ্জীবিত করেছে এবং সময়ের পরিক্রমায় শতাধিক বাংলাদেশী এখোন এই ডিপার্টমেন্টে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হয়েছেন।

এওয়ার্ড নিচ্ছেন শামসুল হক। ছবি-এনওয়াইভয়েস২৪।

শামসুল হকের পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেওয়ার পথ ছিল ব্যতিক্রমী। উচ্চ বিদ্যালয়ের ডিগ্রি ছাড়াই নিউইয়র্কে আগত শামসুল হক কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে নিজের জন্য একটি সুদৃঢ় ভবিষ্যৎ গড়ে তোলেন। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি উচ্চ শিক্ষায়ও বিশেষ কৃতিত্ব অর্জন করেন। তিনি বারুক কলেজ থেকে ব্যবসা-প্রশাসনে স্নাতক ডিগ্রি (বিবিএ) অর্জন করেন এবং সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক’র ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্ট সিনেটের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি বিশ্বখ্যাত কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে মাস্টার্স ডিগ্রি (এমপিএ) লাভ করেন।

এনওয়াইপিডিতে তার কর্ম জীবন ছিল সততা, পেশাদারিত্ব এবং কর্তব্য পরায়ণতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি রাস্তায় টহল পুলিশ থেকে শুরু করে আইন শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে জবাবদিহিতার বিষয়গুলো তদারকি করেছেন। তার দৃঢ় মনোবল এবং কর্তব্য নিষ্ঠার জন্য তিনি সহকর্মী ও কমিউনিটির মানুষের শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন। অবসরের সময় তিনি নিজের ইউনিটের সবচেয়ে সিনিয়র লেফটেন্যান্ট কমান্ডার ছিলেন।

এনওয়াইপিডি থেকে অবসর নিলেও নিউইয়র্ক এবং নিজ জন্মভ’মির মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসা অটুট থাকবে বলে জানালেন শামসুল হক। বহুজাতিক এ বাহিনীতে প্রথম দক্ষিণ এশিয়ান এবং প্রথম মুসলিম লে. কমান্ডার শামসুল হক বলেন, আমি আমার কর্মজীবনে তদন্ত, জননীতি, বিভাগীয় ব্যবস্থাপনা এবং রাজনীতিক ও কম্যুনিটির লোকজনের সহযোগিতার মাধ্যমে আপামর জনতার আস্থা বৃদ্ধি ও তা অটুট রাখতে সততা বজায় রাখা এবং জন-নিরাপত্তা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সেই দক্ষতাকে কাজে লাগিয়েছি। মৃদ্যুভাষী শামসুল হক বললেন, আমার জীবনে অনেক অর্জনের অন্যতম হচ্ছে এনওয়াইপিডিতে কর্মরত বাংলাদেশীদের সমন্বয়ে ২০১৫ সালে ‘বাপা’ (বাংলাদেশী আমেরিকান পুলিশ এসোসিয়েশন)’র প্রতিষ্ঠা এবং পুলিশ কমিশনারকে নিয়ে দুটি টাউন হল মিটিংয়ের আয়োজন, যেখানে ৫ শতাধিক প্রবাসী অংশ নিয়েছেন এবং পুলিশ প্রশাসনের সাথে কম্যুনিটির সম্পর্কের পরিধি বিস্তৃত করার ক্ষেত্রে তা অপরিসীম অবদান রেখেছে বলে মনে করছি।

কমিউনিটির উন্নয়নের জন্য ইতিমধ্যেই তিনি কাজ শুরু করেছেন। ‘রাইজিং আপ নিউইয়র্ক’ নামক একটি সংগঠন গড়ে মূলধারায় নিজেদের হিস্যা আদায়ের ক্ষেত্র প্রসারিত করার অভিপ্রায়ে ভোটার হিসেবে তালিকাভুক্ত এবং সকলকে ভোট যুদ্ধে অবতীর্ণ হবার জন্যে কাজ করছেন শামসুল হক। আর এমন প্রক্রিয়াটিকে অনেকেই মৌলিক একটি প্ল্যাটফরম হিসেবে মনে করছেন। কারণ, আমেরিকান স্বপ্ন পূরণে মূলধারায় সম্পৃক্ততার বিকল্প নেই। নিউইয়র্ক সিটিতে কয়েক লাখ বাংলাদেশী রয়েছেন। এর উল্লেখযোগ্য একটি অংশ ইতিমধ্যেই সিটিজেনশিপ গ্রহণ করলেও ভোটার হিসেবে তালিকাভুক্ত হননি। অর্থাৎ তারা নাগরিক হিসেবে ন্যায্য অধিকার আদায়ে সক্ষম হচ্ছেন না। রেস্টুরেন্ট এবং পথমেলা অথবা অন্য কোন অনুষ্ঠানে দলে দলে হাজির হয়ে বাঘ-ভাল্লুৃক শিকারের কাহিনী আউড়ে কোন লাভ হচ্ছে না। সেটি অনুধাবনে সক্ষম হয়েই শামসুল হক কম্যুনিটির প্রায় প্রতিটি অনুষ্ঠানেই হাজির হচ্ছেন সিটিজেনদের ভোটার হিসেবে তালিকাভুক্ত হবার আহবানে। এ প্রসঙ্গে শামসুল হক বলেন, আমরা চাই আগামী ৫/৭ বছরের মধ্যে কম্যুনিটির লোকজন সিটি, স্টেট এবং ফেডারেল পর্যায়ের নির্বাচনে জয়ী হউক। তাহলে আমাদের নতুৃন প্রজন্মের পথও সুগম হবে মূলধারায় অধিষ্ঠিত হতে। শামসুল হক আবারো উল্লেখ করলেন, যাকে খুশী তাকে ভোট দিন-কোন সমস্যা নেই। ব্যালট যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেই নিজেদের হিস্যা আদায়ের পথ সুগম হয় এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণের কাছে কম্যুনিটির গুরুত্ব বাড়ে। ১৪ বছর এবং ৯ বছর বয়েসী দুই স্কুলগামী পুত্র এবং স্ত্রীকে নিয়ে কুইন্সে বসবাসরত শামসুল হক ইতিমধ্যেই ‘রাইজিং আপ নিউইয়র্ক’র ব্যানারে বেশ কয়েক হাজার প্রবাসীকে ভোটার হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছেন। এই কাজটিকেই এখোন তিনি তার প্রধান দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করেছেন।

ভোটার রেজিস্ট্রেশন ক্যাম্পেইনে শামসুল হক। ছবি-এনওয়াইভয়েস২৪।

শামসুল হক গোলাপগঞ্জ উপজেলার এক আলোকিত পরিবারের সন্তান। তার বড়ভাই আব্দুর রহমান যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশী ও মুসলিম কমিউনিটির কাছে অত্যন্ত এক সু-পরিচিত ব্যক্তিত্ব। দ্বিতীয় ভাই আাব্দুল হক গোলাপগঞ্জের বাঘা ইউনিয়নের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ হাজী আাব্দুল আহাদ উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন স্বনামধন্য শিক্ষক ছিলেন। তিনিও এখান যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। তৃতীয় ভাই মাওলানা নজরুল হকও বহু প্রতিভার অধিকারী এক ব্যক্তিত্ব। তিনি গোলাপগঞ্জের সরকারী আলিয়া মাদ্রাসা থেকে কামিল পাশ করার পাশাপাশি জাতীয় বিশ্ব বিদ্যালয়ের অধীনে এমএ ডিগ্রী অর্জন করেন। তিনিও যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। তার সর্ব কনিষ্ঠ ভাই বদরুল হক যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ বিভাগের একজন কর্মকর্তা। দেশে থাকাকালীন সময়ে বদরুল হক সাংবাদিকতা পেশার সাথে জড়িত ছিলেন। গোলাপগঞ্জের সাংবাদিক সমাজকে নিয়ে একটি অপরাধ মুক্ত সমাজ গঠনে তার প্রশংসনীয় ভূমিকা ছিল। তিনি দীর্ঘ দিন গোলাপগঞ্জ প্রেসক্লাবের সহ সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

এদিকে, লেফটেন্যান্ট শামসুল হকের অবসরগ্রহণ এবং পুলিশ অফিসার মাহবুবুর জুয়েলকে নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগের মুসলিম অফিসার সোসাইটি থেকে সম্প্রতি সম্মানিত করা হয়েছে। সিলেটের এই দুই কৃতি সন্তান বাংলাদেশী আমেরিকান পুলিশ এসোসিয়েশনের সদস্য।

Facebook Comments Box

Posted ৬:৩৬ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৩ এপ্রিল ২০২৫

nyvoice24 |

Address
New York
Phone: 929-799-2884
Email: nyvoice24@gmail.com
Follow Us