ইউনুসের বিপজ্জনক খেলা: এশিয়ায় একটি প্রক্সি যুদ্ধের প্রস্তুতি?

শামীমা চৌধুরী   প্রিন্ট
মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল ২০২৫   সর্বশেষ আপডেট : ৭:৩৮ পূর্বাহ্ণ

ইউনুসের বিপজ্জনক খেলা: এশিয়ায় একটি প্রক্সি যুদ্ধের প্রস্তুতি?

ফাইল ছবি

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান এবং নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুস ক্ষমতায় আজীবন থাকার লক্ষ্যে তিনটি কৌশল গ্রহণ করেছেন। প্রথমত, তিনি ‘ন্যাশনাল সিটিজেনস পার্টি’ (NCP) নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন এবং এর প্রধান দাবি হলো (১) সব সংস্কার সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন স্থগিত রাখা এবং (২) অতীত সরকার অর্থাৎ আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা প্রতারণামূলক মামলাগুলোর নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন না করা। তারা আওয়ামী লীগ (AL)—যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী এবং বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী, সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল—কে নিষিদ্ধ করার দাবিও তুলেছে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বে বাংলাদেশ একটি দারিদ্র্যপীড়িত, দুর্যোগগ্রস্ত এলডিসি দেশ থেকে একটি উন্নয়নশীল ও সম্ভাবনাময় দেশে পরিণত হয়েছিল।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন এবং ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে দেশকে স্বাধীন করেছিলেন।

দ্বিতীয়ত, ড. ইউনুস একটি শক্তিশালী গণমাধ্যম ও ব্লগার বাহিনী গঠন করেছেন যারা আক্রমণাত্মকভাবে নির্বাচন ২০২৯ সাল পর্যন্ত বা তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত স্থগিত রাখার পক্ষে প্রচার চালাচ্ছে।

তাঁর তৃতীয় এবং সবচেয়ে বিপজ্জনক কৌশল হলো—বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে একটি প্রক্সি যুদ্ধ শুরু করা। তিনি পশ্চিমা শক্তিগুলোর জন্য একটি ‘করিডোর’—যার মধ্যে চট্টগ্রাম হিল ট্র্যাক্টস (CHT), কক্সবাজার এবং মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য অন্তর্ভুক্ত—খোলা রাখার প্রস্তাব দিয়েছেন যেখানে সৈন্য চলাচল এবং অস্ত্র স্থানান্তর হবে স্বাধীনভাবে। তিনি সেন্ট মার্টিন দ্বীপে একটি ‘কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল কমিউনিকেশন সেন্টার’ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনাও অনুমোদন দিয়েছেন। এবং “R2P” (Responsibility to Protect) এর আওতায়, ২০১১ সালে লিবিয়ায় প্রয়োগ হওয়া জাতিসংঘের ১৯৭৩ নম্বর প্রস্তাবের মতো একটি “নো-ফ্লাই জোন” আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে।

এই প্রক্সি যুদ্ধের ফলে বাংলাদেশের ২০৪১ সালের মধ্যে একটি সমৃদ্ধ দেশ হওয়ার স্বপ্ন ধ্বংস হয়ে যাবে।

শেখ হাসিনার রোডম্যাপ: ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষুধামুক্ত, ২০৪১ সালের মধ্যে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ

বিশ্বের সর্বাধিক ঘনবসতিপূর্ণ দেশ বাংলাদেশ, যার ১৭ কোটিরও বেশি জনসংখ্যা মাত্র উইসকনসিন রাজ্যের সমান আয়তনের একটি দেশে (যেখানে মাত্র ৫.৬ মিলিয়ন লোক বাস করে), শেখ হাসিনার দক্ষ নেতৃত্বে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা গত ২১ বছর ধরে দেশ পরিচালনা করে বাংলাদেশকে এলডিসি থেকে একটি উন্নয়নশীল দেশে পরিণত করেছেন। তাঁর সময়ে বাংলাদেশের জিডিপি ৯০ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ৪৭৮ বিলিয়ন হয়েছে, মাথাপিছু আয় ও রপ্তানি ৫ থেকে ৬ গুণ বেড়েছে, দারিদ্র্য ৪২% থেকে ১৮%-এ নেমে এসেছে, এবং চরম দারিদ্র্য ২৫% থেকে ৫.৬%-এ নেমেছে।

জন্মহার ২.৯৮ থেকে ১.৩১-এ নেমেছে কোনো বাধ্যতামূলক কর্মসূচি ছাড়াই। স্কুলে ভর্তি ৬৫% থেকে প্রায় ১০০%-এ উন্নীত হয়েছে। গড় আয়ু ৬৩ বছর থেকে বেড়ে ৭৪ বছরে পৌঁছেছে। নারীদের শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ ৫.৬% থেকে ৩৮%-এ পৌঁছেছে এবং পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিমান ও নৌবাহিনীতেও তাদের অংশগ্রহণ বেড়েছে।

নারী ক্ষমতায়ন তাঁর একটি মূল সাফল্য। তিনি অনেক নারীকে উপাচার্য, সরকারি সচিব, বিচারক, জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তা এবং এমনকি সামরিক জেনারেল নিয়োগ দিয়েছেন।

তিনি প্রথমবারের মতো প্রবীণ, প্রতিবন্ধী, দরিদ্র, বিধবা, বেকার এবং গৃহহীনদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি চালু করেছেন। তাঁর সময়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৬.৬% যা ১৯৭৫-৯০ এর সামরিক ও টেকনোক্র্যাটিক সরকারে গড় ছিল মাত্র ৩.২%।

তিনি “ডিজিটাল বাংলাদেশ” থেকে “স্মার্ট বাংলাদেশ” এর রোডম্যাপ গ্রহণ করেছেন। প্রযুক্তিগত দক্ষ জনগণ, স্মার্ট সেবা ও উৎপাদন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রসার ঘটিয়েছেন। জাতিসংঘের মহাসচিব বাংলাদেশকে “অর্থনৈতিক উন্নয়নের মডেল” বলে আখ্যা দিয়েছেন, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল বলেছে “দক্ষিণের আদর্শ” এবং বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপ ভবিষ্যদ্বাণী করেছে এটি বিশ্বের ৯ম বৃহত্তম বাজারে পরিণত হবে। বর্তমানে এটি বিশ্বের ৩৩তম অর্থনীতি; ২০৪১ সালের মধ্যে ২৩তম অর্থনীতি হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

আগস্ট বিদ্রোহ: সব স্বপ্নের অপমৃত্যু

কিন্তু ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ‘সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার’ আন্দোলনের নামে পরিকল্পিতভাবে পরিচালিত এক ছাত্র ও সেনাসমর্থিত বিদ্রোহের মাধ্যমে দেশ এক অনিশ্চয়তা ও বিশৃঙ্খলার মধ্যে পতিত হয়েছে। হাজার হাজার লোক ছাঁটাই হয়েছে, শত শত কারখানা বন্ধ হয়েছে, ২৬.৬ মিলিয়ন মানুষ বেকার হয়েছে, দারিদ্র্য বেড়েছে, মূল্যস্ফীতি আকাশছোঁয়া হয়েছে এবং অধিকাংশ উন্নয়ন কর্মসূচি স্থবির বা বাতিল হয়েছে।

এডিপি অর্জন হয়েছে মাত্র ১৮% এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭.২% থেকে কমে ৩.৮%-এ নেমে এসেছে। জেহাদি ও সন্ত্রাসীরা অন্তর্বর্তী সরকারের ছত্রছায়ায় লুটপাট ও ভাঙচুর চালাচ্ছে। “অপারেশন ডেভিল হান্ট” নামক নিষ্ঠুর অভিযানে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের গ্রেফতার, অর্থ আদায় ও হেনস্তা করা হচ্ছে। বহু মানুষ ভয়ে ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পালিয়ে গেছে এবং সেখানে মানবেতর জীবনযাপন করছে।

বাংলাদেশে বেসরকারি খাতের বিকাশের সম্ভাবনা বিনষ্ট

পূর্ববর্তী সরকার জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মডেলে বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিল। এর ফলে বিকেএসএমসি, প্রাণ, বসুন্ধরা, সামিট, ওয়ালটন, মেঘনা, ব্র্যাক, বেঙ্গল, হা-মীম, আকিজ, মনেম ইত্যাদি গ্রুপ গড়ে ওঠে।

কিন্তু ইউনুস সরকার “সোশ্যাল বিজনেস” নামে এক নতুন ব্যবসায়িক দর্শন চালু করেছে যা কার্ল মার্ক্সের ধারণার মতো—মুনাফার উদ্দেশ্যে নয়, বরং জনগণের সেবা করাই লক্ষ্য। ফলে, অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দেশ থেকে বিদেশে ব্যবসা স্থানান্তর করছে।

ইউনুসের দ্বিতীয় কৌশল: আগ্রাসী প্রচারযুদ্ধ

তাঁর প্রেস সেক্রেটারি, শক্তিশালী মিডিয়া উইং ও ব্লগার বাহিনী ড. ইউনুসকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে রাখার পক্ষে জোর প্রচার চালাচ্ছে। তারা নির্বাচন বাতিলের পক্ষে অসত্য তথ্য ছড়িয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে অকার্যকর করতে চাইছে।

তৃতীয় কৌশল: আঞ্চলিক প্রক্সি যুদ্ধ

পূর্বের রেকর্ড বলছে, ড. ইউনুস তাঁর পদ ছাড়তে রাজি হন না। গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদে থাকতে তিনি হিলারি ক্লিনটন পর্যন্তকে যুক্ত করেছিলেন। এখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে একটি কমান্ড সেন্টার স্থাপন করতে দিয়েছেন যা ভারত মহাসাগরের ট্রাফিক ও রাখাইন অঞ্চলের সৈন্য চলাচল নজরদারি করবে।

যুক্তরাষ্ট্র চায় চীনের প্রভাব কমাতে এবং তাদের মিয়ানমার সংযোগ ও বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত করতে। ইউনুস সিএইচটি ও কক্সবাজার অঞ্চলকে একটি করিডোর বানিয়ে পশ্চিমা বাহিনীকে রাখাইন অঞ্চলে প্রবেশে সহায়তা দিতে চান। এতে বাংলাদেশের ওই অঞ্চলগুলোসহ চট্টগ্রামও হারানোর সম্ভাবনা রয়েছে।

এশিয়ায় প্রক্সি যুদ্ধ: বিপজ্জনক সম্ভাবনা

চীন ও রাশিয়া এই পদক্ষেপকে সহজভাবে নেবে না। তারা মিয়ানমারে পশ্চিমা হস্তক্ষেপে বিরোধিতা করে। ফলে, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এক প্রক্সি যুদ্ধ শুরু হতে পারে, যেখানে অস্ত্র দেবে পশ্চিমারা আর যুদ্ধ করবে বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের সেনারা। এতে বহু প্রাণহানি ঘটবে, হাজার হাজার শিশু অনাথ হবে।

মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের শিক্ষাঃ যুদ্ধ মানেই ধ্বংস

মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘমেয়াদি প্রক্সি যুদ্ধে ধনী দেশগুলোও ধ্বংস হয়েছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে ইউরোপও আজ সংকটে। সুতরাং, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার ছাড়াও ভারতের মতো উদীয়মান অর্থনীতিগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এমন যুদ্ধ শুরু হলে এশিয়ার উত্থান থেমে যাবে।

ড. ইউনুসের স্বার্থপর অভিলাষ: যুদ্ধের কারণ

জেলেনস্কি যেভাবে যুদ্ধের অজুহাতে নির্বাচন স্থগিত করেছিলেন, ইউনুসও সেটাই করতে চান। এখন পর্যন্ত তাঁর ২৫০ দিন পার হলেও নির্বাচন নেই। যুক্তরাষ্ট্রও এখন চুপ। তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে আওয়াজ নেই। ফলে, এখনই দেশের জনগণ যদি প্রতিরোধ না গড়ে তোলে, ভবিষ্যতে দেশ ও অঞ্চল দীর্ঘদিন দুর্ভোগে পড়বে।

Facebook Comments Box

Posted ৮:৫১ পূর্বাহ্ণ | মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল ২০২৫

nyvoice24 |

Address
New York
Phone: 929-799-2884
Email: nyvoice24@gmail.com
Follow Us