বিএনপিকে চাপে রাখতেই আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ?

অনলাইন ডেস্ক   প্রিন্ট
রবিবার, ১১ মে ২০২৫   সর্বশেষ আপডেট : ১১:০৯ পূর্বাহ্ণ

বিএনপিকে চাপে রাখতেই আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ?

গত বছরের ৫ অগাস্ট সরকার পতনের পর ঢাকায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে হামলার ঘটনা ঘটে। জেলায় জেলায়ও একই ঘটনা ঘটেছে গত নয় মাস ধরে। অবশেষে চাপের মুখে ১০ মে দলটিকেই নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত আসে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক থেকে।

আওয়ামী লীগের রাজনীতি যে নিষিদ্ধ করা হবে—সেটি গত ৮ অগাস্টের পরে ছিল সময়ের ব্যাপারমাত্র। কেননা, মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং এরপরে গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) তরফে অব্যাহতভাবে জুলাই অভ্যুত্থানে গণহত্যার দায়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা এবং নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন বাতিলের দাবি জানানো হচ্ছিল। যে দাবিতে গত বৃহস্পতিবার (৮ মে) রাত ১০টা থেকে পরদিন দুপুর পর্যন্ত প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে অবস্থান করে এনসিপি। তাদের সঙ্গে একাত্মতা জানায় আরও কিছু দল ও সংগঠন। শুক্রবার জুমার নামাজের পরে তারা মিন্টো রোডের মুখে ট্রাকের ওপরে অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করে গণজমায়েত করে। এরপর এই জায়গা ছেড়ে দিয়ে অদূরে শাহবাগে গিয়ে অবরোধ (ব্লকেড) করে। সবশেষ শনিবার সন্ধ্যার পরে তারা আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাতে সরকারকে এক ঘণ্টা সময় দেয়।

ছবি: শনিবার সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার দাবিতে এক ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়ে ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে জড়ো হয়ে অপেক্ষা করছিলেন বিক্ষোভকারীরা।

শনিবার রাত ১১টায় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়, উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ সভায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও তার নেতাদের বিচারকার্য সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, জুলাই আন্দোলনের নেতাকর্মীদের নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বাদী ও সাক্ষীদের সুরক্ষার জন্য সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অধীনে সাইবার স্পেস-সহ আওয়ামী লীগের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। সেইসাথে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল আইনের সংশোধনী অনুমোদিত হয়েছে। সংশোধনী অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল কোনো রাজনৈতিক দল, তার অঙ্গসংগঠন বা সমর্থক গোষ্ঠীকে শাস্তি দিতে পারবে। পাশাপাশি, উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আগামী ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করে প্রকাশ করার সিদ্ধান্তও গৃহীত হয়েছে।

বস্তুত, আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিটি গত ৯ মাস ধরে জারি থাকলেও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কথায় মনে হয়েছে, তিনি বা তার সরকার আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের পক্ষে নন। গত ২০ মার্চ ঢাকায় ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের কমফোর্ট ইরোর নেতৃত্বাধীন একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আলোচনায় প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার কোনো পরিকল্পনা সরকারের নেই। তবে দলের যেসব নেতার বিরুদ্ধে হত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধসহ অন্যান্য অপরাধের অভিযোগ রয়েছে, বাংলাদেশের আদালতে তাদের বিচার করা হবে।

এর আগে মার্চের শুরুতে বিবিসি বাংলাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা বলেছিলেন, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নেবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত তারা নেবে। অবশ্য তিনি এ–ও বলেন, নির্বাচনে কে অংশ নেবে, তা নির্বাচন কমিশন ঠিক করবে।

গত ২ এপ্রিল লক্ষ্মীপুরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেছেন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার বিষয়ে সরকার একা সিদ্ধান্ত নেবে না। রাজনীতিক দল ও দেশি-বিদেশি উন্নয়ন সহযোগীদের পরামর্শে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

যদিও দেখা গেল যে, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই সরকার মূলত জাতীয় নাগরিক পার্টির চাপ ও আলটিমেটামের মুখে আওয়ামী লীগের সকল কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা দিলো। প্রশ্ন হলো, কোনো এক বা একাধিক দল সরকারের ওপর যেকোনো বিষয়ে চাপ প্রয়োগ করলেই সরকার সেই দাবি মেনে নেবে?

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা যেখানে সরাসরি বলেছিলেন যে, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার কোনো পরিকল্পনা তার সরকারের নেই; সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টাও যেখানে বললেন যে তারা এ বিষয়ে এককভাবে সিদ্ধান্ত নেবেন না— সেখানে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত হলো কী করে? তাহলে কি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে যে দলগুলো বৃহস্পতিবার রাত থেকে রাজপথে ছিল, তাদের বাইরে বিএনপিসহ অন্য দলগুলোর সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্টরা ব্যক্তিগতভাবে বা অফিসিয়ালি যোগাযোগ করে তাদের মতামত নিয়েছেন, নাকি সরকার অন্যদের মতামত নেয়ার কোনো প্রয়োজনবোধ করেননি? নাকি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের প্রক্রিয়াটি ভেতরে ভেতরে চলছিল—যেটিকে বৈধতা দেয়ার জন্য এমন একটি পরিস্থিতি তৈরির প্রয়োজন ছিল, যাতে সরকার বলতে পারে যে, তারা এককভাবে সিদ্ধান্তটি নেয়নি, বরং রাজনৈতিক চাপেই আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে?

জামায়াত থেকে আওয়ামী লীগ

মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতা তথা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণগত্যার সহযোগী হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি ছিল বহু বছর ধরেই। কিন্তু কোনো সরকারই, এমনকি মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী দল আওয়ামী লীগও জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করেনি। বরং ভোটের সমীকরণে জামায়াতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের আঁতাত বা সমঝোতার ইতিহাসও রয়েছে। কিন্তু গত বছরের জুলাই মাসে যখন সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনটি সহিংসতায় রূপ নিলো এবং ধীরে ধীরে এটি সরকার পতনের একদফা আন্দোলনের দিকে গড়ালো, সেই মুহূর্তে আন্দোলন দমনের কৌশল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার।

গত বছরের ২৯ জুলাই বিকালে গণভবনে অনুষ্ঠিত ১৪ দলীয় জোটের সভায় জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠক শেষে বেরিয়ে ১৪ দলের নেতারা এই সিদ্ধান্তের কথা জানান। ভোটের সমীকরণে যে ১৪ দলের তেমন কোনো গুরুত্ব ছিল না বা যে ১৪ দলকে আওয়ামী লীগ খুব একটা পাত্তা দিচ্ছিল না, সেই ১৪ দলের বৈঠক ডেকে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তটি ছিল আওয়ামী লীগের একটি কৌশল। কেননা ক্ষমতাসীন দল হিসেবে এককভাবে সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে তারা জামায়াত নিষিদ্ধের প্রজ্ঞাপন জারি করার ক্ষমতা রাখলেও ১৪ দলের বৈঠকের মধ্য দিয়ে সিদ্ধান্তটি নিয়েছে, যাতে এর ‘পলিটিক্যাল লেজিটিম্যাসি’ থাকে। যাতে আওয়ামী লীগের শরিকদের কেউ এটা বলতে না পারে যে, তাদের সঙ্গে আলোচনা না করেই বা তাদের মতামত না নিয়েই আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনা এককভাবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। উপরন্তু আওয়ামী লীগও দেশে-বিদেশে এই বার্তা দিতে চেয়েছে যে, সিদ্ধান্তটি তাদের একার নয়। বরং জোটব্দ্ধভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েই কাজটি করা হয়েছে।

একই প্রক্রিয়ায় যখন অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধের প্রক্রিয়া শুরু হয়, তখন অন্তর্বর্তী সরকারের তরফেও বলা হয় যে, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তবে গত জুলাইয়ে জামায়াত নিষিদ্ধের সময়ে সরকারের কৌশলের সঙ্গে এবার আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের সময় সরকারের কর্মপদ্ধতির মূল পার্থক্য হলো, জামায়াত নিষিদ্ধ করা হয়েছিল ১৪ দলের সঙ্গে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী। আর এবার আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করা হলো মূলত এনসিপির চাপে ও আলিটিমেটামের মুখে। তার মানে, সরকার এই দলটিকে কতটা গুরুত্ব দেয় ও সমীহ করে; আগামীর রাজনীতিতেত এই দলটি কতটা ফ্যাক্টর হয়ে উঠবে; বিচার, সংস্কার, নির্বাচনসহ আরও অনেক ইস্যুতে তারা সরকারের ওপর কীভাবে প্রভাব বিস্তার করবে বা করতে পারবে—তা এই ঘটনার মধ্য দিয়ে আরও একবার স্পষ্ট হয়েছে।

পরিপত্র একটি কাগজ ছাড়া কিছুই নয়

যে কোনো রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠে একটি আদর্শের ভিত্তিতে। বিশেষ করে যেসব দল দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকেছে, লড়াই সংগ্রাম করেছে, যেসব দলের শক্ত জনভিত্তি আছে—সেসব দলকে প্রজ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে নিষিদ্ধ করলেই জনমানুষের স্মৃতি থেকে মুছে যায় না। নিষিদ্ধ হলে তারা আইনত প্রকাশ্যে মিছিল সমাবেশ বা কর্মসূচি পালন করতে পারে না। করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের গ্রেপ্তার করতে পারে। কিন্তু যে লোকগুলো এই দলের সঙ্গে বছরের পর বছর ধরে এই দলের নীতি-আদর্শ ও কর্মসূচির সঙ্গে একাত্ম হয়ে যুক্ত ছিলেন, তারা কি দল নিষিদ্ধ হওয়ার পরে অন্য দলে যোগ দেবেন? আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হলেই কি এই দলের সব সমর্থক ও ভোটার বিএনপি বা এনসিপিকে ভোট দেবেন?

নিষিদ্ধ হওয়ার ফলে আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না—যদি ওই নির্বাচনের আগে তাদের ওপর এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা না হয়। কিন্তু নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণার জন্য নিষিদ্ধ করারও প্রয়োজন হয় না। বরং নিবন্ধন বাতিল করে দিলেই হয়। তারপরও নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছে এবং নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে যাতে আওয়ামী লীগ বা তার কোনো অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন কোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড করতে না পারে। যাতে আওয়ামী লীগের কোনো নাম-নিশানা না থাকে। যেহেতু জুলাই অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগের পতন হয়েছে, অতএব কোনো না কোনো ফরম্যাটে আওয়ামী লীগ দৃশ্যমান থাকলে ওই অভ্যুত্থানের সামনের সারিতে থাকা নেতাকর্মী, বিশেষ করে এনসিপির সঙ্গে যুক্ত নেতাকর্মীরা হয়তো সেটিকে নিজেদের জন্য ঝুঁকির কারণ বলে মনে করেন।

বাস্তবতা হলো, আওয়ামী লীগের মতো একটি দল শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিগত ১৬ বছরে অনেকটা জনবিচ্ছিন্ন, বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ হলেও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া এবং দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার ফলে তার যে বিরাট ভোটব্যাংক ও জনভিত্তি তৈরি হয়েছে, সেটি ‍শুধুমাত্র একটি প্রজ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে মুছে ফেলা কঠিন।

মনে রাখতে হবে, সরকারি প্রজ্ঞাপন একটি এক পৃষ্ঠার কাগজ বৈ কিছু নয়। যেমন অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগের পতনের পাঁচদিন আগে গত বছরের পয়লা অগাস্ট জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ যে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল, সেটি প্রত্যাহার করে আরেকটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের ২০ দিনের মাথায় গত বছরের ২৮ অগাস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জারি করা ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘যেহেতু বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং উহার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ উহার সকল অঙ্গ সংগঠনের সন্ত্রাস ও সহিংসতায় সম্পৃক্ততার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায় নাই; এবং যেহেতু সরকার বিশ্বাস করে যে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং উহার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ উহার সকল অঙ্গ সংগঠন সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সাথে জড়িত নহে তাই দলটির নিষিদ্ধ ঘোষণা সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন বাতিল করা হলো।’

সুতরাং, এখন যে সরকারি প্রজ্ঞাপন বা পরিপত্রের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হলো, ভবিষ্যতে যেকোনো সময় আরেকটি প্রজ্ঞাপন জারি করে সেটি প্রত্যাহার বা বাতিল করা অসম্ভব নয়। কিন্তু এটি যদি বিচারিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে হয় এবং সেই বিচারটি যদি নিরপেক্ষ ও সরকারি প্রভাবমুক্তভাবে সম্পন্ন হয়, তাহলে ভবিষ্যতে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠতো না বা কম বিতর্ক হতো।

নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত জনগণের

সরকারি সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা কোনো গণতান্ত্রিক পন্থা নয়। কেননা কোন দলকে জনগণ গ্রহণ করবে বা কাকে প্রত্যাখ্যান করবে, সেই বিবেচনার ভার জনগণের। জনগণ যদি ভোটের মধ্য দিয়ে প্রত্যাখ্যান করে, তাহলে আওয়ামী লীগ এমনিতেই ধীরে ধীরে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে। যেমন জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার দাবি বহু বছর ধরে থাকলেও তাদের গত বছরের অগাস্টের আগ পর্যন্ত নিষিদ্ধ করা হয়নি। কিন্তু বৈধ রাজনৈতিক দল থাকা অবস্থাতেও তারা নির্বাচন করেও খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। বরং তাদেরকে নির্বাচন করতে হয়েছে বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে। তারপরও তারা খুবই সামান্য কিছু আসনে জয়ী হয়েছে। তার মানে মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতা কিংবা ধর্মীয় দল—যে কারণেই হোক, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ জামায়াতকে গ্রহণ করেনি। কিন্তু তারপরও জুলাই আন্দোলনের শেষদিকে সেই জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার পাঁচদিনের মাথায় খোদ আওয়ামী লীগেরই পতন হলো এবং মুক্তিযুদ্ধে বিতর্কিত ও দেশবিরোধী ভূমিকার কারণে যে দলটির রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি ছিল বহু বছর ধরে, সেই দলটির নিষিদ্ধ করার প্রজ্ঞাপনটি বাতিল করে দেয়া হলো এক মাসের মধ্যে। তার মানে সরকারি প্রজ্ঞাপন দিয়ে দল নিষিদ্ধ করাটিই সমাধান নয়। বরং জনগণ যদি ভোট না দেয়, সমর্থন না করে, সেই দল এমিনিতেই ধীরে ধীরে মাইনাস হয়ে যায় বা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে—যদি নির্বাচনি ব্যবস্থাটি ত্রুটিমুক্ত থাকে। যদি দেশে একটি গণতান্ত্রিক আবহ থাকে। সুতরাং জনগণ যদি মনে করে যে, মুক্তিযুদ্ধে যে ভূমিকাই থাকুক না কেন, দীর্ঘ স্বৈরশাসনের কারণে তারা আর আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে না বা ক্ষমতায় আনবে না, সেই সিদ্ধান্তের ভার জনগণের ওপরেই থাকা উচিত।

বিএনপিকে চাপে রাখার কৌশল?

আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধের বিষয়ে বিএনপি শুরু থেকেই মধ্যপন্থা অবলম্ব করেছে। অর্থাৎ তারা জুলাই অভ্যুত্থানে গণহত্যার সঙ্গে যুক্ত আওয়ামী লীগের নেতাদের বিচারের দাবি জানালেও সরকারি প্রজ্ঞাপন বা পরিপত্র জারির মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের পক্ষে ছিলেন না। তবে তারা মনে করেন, যদি ট্রাইব্যুনালের কোনো রায় বা পর্যবেক্ষণের আলোকে দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হয়, তাতে তাদের আপত্তি নেই। ফলে এনসিপির নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলন ও আলটিমেটামের মুখে সরকারি পরিপত্র জারির মাধ্যমে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার এবং তাদের প্রধান স্টেকহোল্ডাররা বিএনপিকে এমন একটি বার্তা হয়তো দিতে চাইল যে, তারা যা বলবে ও যেভাবে চাইবে, সবকিছু সেভাবেই হবে।

যেহেতু অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগের পতনের পরে সরকারের সামনে এখন একমাত্র বা প্রধান অন্তরায় হচ্ছে বিএনপি, যারা দ্রুত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানাচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার ও এনসিপি যে দ্রুত নির্বাচন চায় না— সেটি এরই মধ্যে নানা ঘটনায় এবং সরকারের বডি ল্যঙ্গুয়েজে স্পষ্ট হয়েছে। সুতরাং তাদের এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে প্রধান বাধা যেহেতু বিএনপি, অতএব তাদেরকে আরও বেশি চাপে ফেলার জন্যই এই প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হলো কি না— সেই প্রশ্ন অনেকের মনেই আছে। অতএব, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার কোনো পরিকল্পনা সরকারের নেই— স্বয়ং সরকার প্রধানকে এই কথা থেকেই যেখানে সরে আসতে হয়েছে, সেখানে তিনি যে বারবার বলছেন আগামী ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুলাইয়ের মধ্যে নির্বাচন হবে— সেই প্রতিশ্রুতিও তিনি রাখতে পারবেন কি না— সেটি এখন বড় প্রশ্ন। কেননা, বিএনপি ও তার শরিকরা ওই সময়ের মধ্যে নির্বাচনের চাপ দিলেও এনসিপি ও জামায়াতসহ আরও কিছু দল যদি সরকারের ওপর অন্য কোনো ইস্যু নিয়ে চাপ দেয় এবং কাঙ্ক্ষিত সংস্কার ও অন্যান্য দাবি পূরণের আগ পর্যন্ত কোনো নির্বাচন হবে না বলে আলটিমেটাম দেয়, সরকার তখন কী করবে বা করতে পারবে? সৌজন্যে: বিডিনিউজ২৪

Facebook Comments Box

Posted ১১:০০ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ১১ মে ২০২৫

nyvoice24 |

Address
New York
Phone: 929-799-2884
Email: nyvoice24@gmail.com
Follow Us