-ড. বিরুপাক্ষ পাল
প্রিন্ট
বৃহস্পতিবার, ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট : ১০:৪৭ পূর্বাহ্ণ
ছবির ক্যাপশন-বিভ’রঞ্জন সরকার
সুবর্ণধারার সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকার সম্প্রতি স্বেচ্ছায় পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। মহাভারতের ভীষ্মের মত তিনি সম্ভবত স্বেচ্ছামৃত্যুর বরলাভ করেছিলেন প্রকৃতি-ঈশ্বরের কাছ থেকে। সবাই তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করেছেন। কিন্তু তিনি অনেক আত্মার অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর জন্য শোক আর দশ জনের মত নয়। বন্ধুবান্ধব ও স্বজনদের জন্য এটি ধিকি ধিকি আগুনের মতো জ্বলে।
শাস্ত্র বলেছে-আত্মহত্যা পাপের বিষয়। কিন্তু বিভুদা স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করেছেন। একটু পার্থক্য আছে। ভীষ্ম ধর্মের জয় দেখে যুদ্ধ শেষে জীবন প্রদীপ নিভিয়েছিলেন। বিভুদা অধর্মের জয় দেখে নিজেকে নিঃশেষ করেছেন। হতাশা ছিল সত্যি। কিন্তু সেটিই এই অকালমৃত্যুর মূল কারণ নয়। যারা এই মৃত্যুর নিকটবর্তী কারণ হয়ে দাঁড়ালেন-কিংবা নিজেদের আড়াল করলেন-একদিন তাদেরও পরিণতি এরকম হতে পারে।
বাকস্বাধীনতার এই “স্বর্ণযুগে” বিভুদার মৃত্যু পুলক বন্দোপাধ্যায়ের মৃত্যুর সাথে সমতুল্য নয়। পুলকের বাণী বা কথা ছিল বলেই মান্না দে’র গান এত জীবন্ত হয়েছিল। সেই পুলক জীবনের বিকেলে ভাবলেন, তিনি আর আগের মত সৃষ্টিশীল নন। গঙ্গায় ঝাঁপ দিলেন। বিভুদাও হয়তো মেঘনায় ঝাঁপ দিয়েছেন, অথবা ওর উজানের কোনো নদীতে। বিভুদার জীবনের চূড়ান্ত সঙ্গীত তাঁর জীবনের শেষ পত্র-যেখানে সাহিত্য, সমাজ, সমকালীন সরকার, অসুস্থ্য রাজনীতি ও মধ্যবিত্তের কঠিন দিনযাপনের গল্প রয়েছে।
আশির দশকের প্রভাবশালী সাপ্তাহিক ‘যায় যায় দিন’এ তিনি তারিক ইব্রাহিম নামে লিখতেন। তাঁর কলাম তখন সবচেয়ে জনপ্রিয়। তার রাজনৈতিক বিশ্লেষণ দেখে আমারও সখ হলো রাজনীতি নিয়ে লিখবো। নব্বই দশকের শুরুতে একদিন এক রাজনৈতিক লেখা নিয়ে দেখা করলে তিনি তা ছাপেননি। বরং অর্থনীতি নিয়ে লিখতে বলেছিলেন। সেদিন কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলেও আজ সময়ের বিচারে বুঝতে পারছি যে বিভুদা দীর্ঘমেয়াদে আমার উপকারই করেছিলেন। আগে এরকম ইমেইল বা হোয়াটসঅ্যাপ ছিলনা। একদিন লেখা দিতে তাঁর বাসায় গেলে বৌদির হাতে চা-নাস্তা খেয়েছিলাম। বিভুদা পরিমিত সুরে কথা বলতেন। কাউকে অতি প্রশংসার তোষামুদি তাঁর মধ্যে ছিলনা বলে আজকের চালাক দুনিয়ার অনেক স্থানেই বেমানান হয়ে পড়েছিলেন।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ায় আমি মিখাইল গর্বাচভকে অপছন্দ করতাম। কোনো ছাত্ররাজনীতি করিনি। কিন্তু মনে হতো বিশ্বে পুঁজিবাদী ও সমাজবাদী আদর্শের মধ্যে একটা ভারসাম্য থাকা উচিত। সোভিয়েত ইউনিয়ন তা রাখতে পেরেছিল। এখন সবই এক গোয়ালের গরু। গর্বাচেভের বিরুদ্ধে ‘বিচিন্তা’য় লিখে লিখে একটি বইই বের করে ফেলেছিলাম। হঠাৎ একদিন দেখলাম, বিভুদা সম্ভবত ‘ভোরের কাগজ’-এ লিখেছেন “অচেনাকে চিনে চিনে উঠবে জীবন ভরে।’’ সেখানে তিনি গর্বাচভ পরবর্তী রাশিয়ার নতুন কিছু দেখার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। আমার বিতর্ক করার স্বভাবটি জেগে উঠলো। আমার এই স্বভাবটি সংসারের গন্ডিতে পরাজিত হলেও বাইরে কিছুটা কদর পেয়েছে। আমি বিভুদার বিরুদ্ধে লিখলাম। সম্পাদক মতিউর রহমান অকাতরে তা ছাপলেন। এরপর এক অনুষ্ঠানে দেখা হলে তিনি আগ বাড়িয়েই আমাকে সহজ করে নিলেন। বিনয়ী মানুষ ছিলেন তো।
১৯৯৬ সালে আমি অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী হই। এর পরও দীর্ঘদিন আমাকে ডাকযোগে ‘জনকণ্ঠ’ পাঠানো হতো। দেখতাম পত্রিকার প্রথম পাতায় বিভুরঞ্জনের অসামান্য রাজনৈতিক বিশ্লেষণ। তখন ‘জনকণ্ঠ’ই সর্বোচ্চ প্রচারিত দৈনিক ছিল। ওই সময় অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনও বিশ্লেষণ লিখতেন। বিভুদা সম্ভবত ২০০১ সালের দিকে ‘মাতৃভূমি’ পত্রিকার সম্পাদক হন। সিডনিতে বন্ধুবর অজয় দাশগুপ্তকে ফোন করেছিলেন লেখার জন্য। চেয়েছিলেন আমার লেখাও। এককালে তাঁর বিরুদ্ধে কলম ধরার পরও বিভুদা যে গুণগ্রাহিতা ও বিনয়ের পরিচয় দিলেন-তা আজকাল অনেক সাংবাদিকের মধ্যে বিরল। আমি তখন যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনার জন্য যাবো বলে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। লেখা দেওয়া হয়নি।
আমি বাংলাদেশ ব্যাংকে থাকার সময় ২০১৫ সালে হঠাৎ একদিন আমার পিএস জানালেন, বিভুরঞ্জন নামে একজন দেখা করতে চান। প্রথমে ভাবলাম কোনো ব্যাংক থেকে ঋণ করিয়ে দিতে হবে হয়তো। অথবা ছেলেমেয়ের কেউ হয়তো লিখিত পরীক্ষায় পাশ করেছে। সামনে ভাইবা। যেহেতু ভাইবা মানে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি কিংবা অন্যায্য বঞ্চনার পচাপুকুর, তাই ওসব স্থানে যেন যোগ্য প্রার্থী বঞ্চিত না হন-সেরকম অনুরোধও করতে পারেন। অতি সাধারণ পোষাকে বিভুদা সামনে এসে বসলেন। তখন বেলা বারোটা হবে হয়তো। তাকে শুধু চা খাইয়ে আপ্যায়ন করলাম। বাইরে থেকে খাবার আনাতে চাইলাম। তিনি না করলেন। সেদিন কেন যে তাকে জোর করে মধ্যাহ্ন আহারে আপ্যায়ন করালাম না-তা নিয়ে এখন কষ্ট পাচ্ছি।
না, কোনো তদ্বির নিয়ে আসেননি। এসেছিলেন এক ‘অদ্ভুত’ প্রস্তাব নিয়ে। দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য একটি সংগঠন করবেন। আমাকে এখানে বড় দায়িত্ব নিতে হবে। আজকের বিচারে এগুলো এক অদ্ভুত প্রচেষ্টাই বটে-যেখানে রাষ্ট্রযন্ত্রই সম্প্রীতির পরিবর্তে দুর্বলের উপর অত্যাচার প্রশ্রয় দিচ্ছে, কখনো তালিম দিচ্ছে। আমি সবিনয়ে বিভুদাকে শান্ত করলাম। বললাম, ওয়াহিদুল হকের মতো মানুষ এখানে দরকার। তাছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চুক্তিবদ্ধ হয়ে কাজ করছি। বাইরে কিছু করা সম্ভব নয়। আমার ‘না’ করার বিষয়টি এখানে বড় নয়। বড় হচ্ছে সাংবাদিকতার পাশাপাশিও বিভুদার একটি অসাম্প্রদায়িক সমাজ বিনির্মাণে চেষ্টার কথা। বেঁচেবর্তে থাকলেও উন্নত চিন্তা করতেন।
সর্বশেষ বিভুদা আমার কাছে ‘আজকের পত্রিকা’র বর্ষপূর্তির বিশেষ সংখ্যার জন্য অর্থনীতির ওপর লেখা চাইলেন ২০২৪এর সম্ভবত জুন মাসে। আমি প্রশ্ন করলাম, মালিক পয়সা দেবে তো? আমার এই প্রশ্নটিতে অনেকেই বিব্রত হন। কেউবা আমাকে ছোটলোক ভেবে থাকেন। কিন্তু আমার এতে শরম কম। কারণ আমি মনে করি যে মালিকরা মুনাফার জন্য পাগল। কিন্তু অনেক লেখককে পয়সা দিতে কার্পণ্য করেন। তারা ভাবেন যে লেখকরা বোধয় তাদের লেখা ছাপা হয় বলেই ধন্য হবেন। থাক সে কথা। বিভুদা বললেন, ভালো সম্মানী তিনি আদায় করিয়ে দেবেন। তারপর জুলাইয়ের পটপরিবর্তন শুরু হলে লেখাটি বোধয় আর ছাপা হয়নি। কিংবা হয়েছে। খোঁজও রাখিনি।
এরপর তো নিত্যদিনই নতুন উপলব্ধির জন্ম-কী চেয়েছি আর কি যে পেলাম! সে ঘোর থেকে বিভুদাও মুক্ত হতে পারেননি। সত্য ও ন্যায়ের পথে থাকতে গিয়ে তার জীবিকার উপর চাপ পড়েছে। এককালের সবচেয়ে মেধাবী সাংবাদিক ও ক্ষুরধার লেখক জীবনের শেষ দিকে ওষুধ আর ভাত কাপড় জুটাতে পারতেন না। মেয়ে ডাক্তার ও ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হয়েও উপার্জনে অক্ষম। হয়তো ওদের নাম অথবা ওদের বাবার নাম এই “নিরপেক্ষ” সরকারের আমলে একটা বড় সমস্যার নাম। সে ইংগিতও রয়েছে তাঁর চিঠিতে।
সে চিঠি যারা পড়েননি, তারা অবশ্যই সেটি পড়বেন। এ এক সাহিত্যের দলিল হয়ে থাকবে। আমি একদমে পড়েছি। শেষ লাইনটি পড়ে চোখের কোণে এক বিন্দু অশ্রু সঞ্চিত করেছি। নির্মোহ বিভুদার প্রতি সেটিই আমার একমাত্র অকৃপণ শ্রদ্ধাঞ্জলি। বিভুদা, আপনি কাউকে কিছু করার সুযোগ দিলেন না। এভাবে না বলে চলে যাওয়া আপনার ঠিক হয়নি। এ কষ্ট ভোলার নয়। আমরা কিছু করতে পারিনি বলেই মেঘনা আপনাকে বহন করে নিয়ে যাচ্ছিল বঙ্গোপসাগরে – তারপর মহাসমুদ্রে। সে ঠিকানাই হয়তো আপনার জন্য যোগ্য ছিল।
ছবির ক্যাপশন-বিভ’রঞ্জন সরকার
বিভুরঞ্জন সরকার।
=========
Posted ১০:৪৭ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫
nyvoice24 | New York Voice 24