আমেরিকার মেমফিসে ৪৬ বছরে শারদ উৎসব

জুলি বসু রায়   প্রিন্ট
মঙ্গলবার, ০৭ অক্টোবর ২০২৫   সর্বশেষ আপডেট : ৮:৪৬ পূর্বাহ্ণ

আমেরিকার মেমফিসে ৪৬ বছরে শারদ উৎসব

দুর্গাপূজায় মেমফিসের প্রবাসীরা। ছবি-এনওয়াইভয়েস২৪ ডটকম।

দুর্গা পুজোর উৎসস্থল থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি রাজ্যের অন্তর্গত দুশো বছরের প্রাচীন শহর মেমফিস। “রক এন্ড রোল” এর প্রবর্তন কেন্দ্র এই শহরে কেটেছে প্রবাদপ্রতিম শিল্পী এলভিস প্রিয়েস্টলির জীবনের বেশ কিছু বছর। আবার কৃষ্ণাঙ্গ আন্দোলন এর ইতিহাস আজও কান পাতলে শোনা যায় এই শহরের ইট কাঠ পাথরের আনাচে কানাচে। এখানে বহুজাতিক মানুষের মাঝে আছেন বেশ কিছু ভারতীয় ও বাংলাদেশী বাঙালি পরিবার, যারা আশ-পাশের শহর থেকে আসা আরও কিছু বাঙালির সাথে এক যোগে, নিয়ম নিষ্ঠা মেনে, গত ৪৬ বছর ধরে পালন করে আসছে আমাদের শ্রেষ্ঠ উৎসব- দুর্গাপূজা।

বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণ, হোমানলের পবিত্র শিখা, ভরপুর বাঙালিয়ানা, কুমারী পূজা, সিঁদুর খেলা আর অনাবিল আনন্দ- এই সব নিয়েই এ বছর ৪৬ এ পা দিলো মেমফিসে উৎসব পালন। সঙ্গে পূজা নিবেদন-এর পুরোধা, পেশায় হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ, ডাক্তার ইন্দ্রনীল বসু রায়। তবে চিকিৎসক-পুরোহিতের রেওয়াজ এই শহরে প্রথম থেকেই- দীর্ঘ চার দশকের একনিষ্ঠ পুরোহিত, ডাঃ জয়ন্ত দীর্ঘাঙ্গী, ছিলেন পেশায় স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ। এ বছরও পুজোর তিনটে দিন সমস্ত আচার বিধি মেনে মায়ের আরাধনা সম্পন্ন হয়েছে – বড়ো যত্নে মৃন্ময়ী মার মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছেন আমাদের ঠাকুরমশাই। শুধু তাই নয়, আপামর মানুষ যাতে পূজোর কাজে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে পারেন, তাই সংস্কৃত মন্ত্রগুলির ইংরেজি ও বাংলায় তর্জমা করে সেই পুজো বিধি-র বৈশিষ্ট্য সংক্ষিপ্ত ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি। আর এই কারণেই মেমফিসের পুজো শুধু একা পুরোহিতের নয়, আমাদের ‘সবার’ হয়ে ওঠে – যজ্ঞে আহুতিদান থেকে শুরু করে, প্রতিদিন মাকে আরতি করা- এই সব কাজেই আমাদেরও ভূমিকা থাকে পূজারী-র যোগ্য পরিচালনায়।

বোধন থেকে সন্ধিপুজো, চন্ডীপাঠ, পুষ্পাঞ্জলি বা মায়ের দর্পণে বিসর্জন, কুমারী পূজো, সিঁদুর খেলা কিছুই বাদ যায় না। বলিদানও সম্পন্ন হয় লাউ, কুমড়ো, আঁখ… যে সবজি পাওয়া যায় তাই দিয়ে- সব নিয়ম-ই মানা হয় নিষ্ঠা সহকারে এই পুজো-তে। নবীন ও প্রবীণ- এই দুই প্রজন্মের সদস্য নিয়ে গঠিত পুজোর মূল পরিচালক দল। তাই প্রবীণের প্রাজ্ঞতার সাথে নবীনের উদ্যম মিলে গিয়ে তিনটে দিন খুব আনন্দে কাটাই আমরা। “পুজো এলেই বড়ো মন কেমন করতো দেশের জন্য। ভাবতাম ছেলে মেয়েরা বাঙালি হয়েও শুধু বড়দিনের আড়ম্বর দেখবে, অথচ ওদের সংস্কৃতিতেও যে দুর্গাপুজোর মতো একটা গুরুত্ত্বপূর্ণ উৎসব আছে তা জানবেনা। আশপাশের বড়ো শহর গুলোতে পুজো হতো তাই আরও মন খারাপ হতো.”- এই ভাবনা থেকেই, শ্রীমতি ছন্দা বিশ্বাস, ডা. দীর্ঘাঙ্গী, ডঃ ভট্টাচার্য এবং আরও সাত-আটটি পরিবারের যৌথ উদ্যোগে ৪৬ বছর আগে মেমফিস শহরেরই এক গির্জায় শুরু হয়েছিল প্রথম পুজো। ডেট্রয়েটের জনৈক পরিচিতর বাড়ি থেকে আনা লক্ষ্মী-সরস্বতী-কার্তিক-গনেশ বিহীন, শুধু মাত্র মা দুর্গার একখানি ছবি দিয়ে যে পুজো শুরু হয়েছিল, পরবর্তীকালে কুমোরটুলি থেকে আনা পূর্ণ প্রতিমার মধ্য দিয়ে মেমফিসে মৃন্ময়ীর আগমন আজ ৪৬ বছরে পা দিলো।

পুজোর আয়োজনে কোথাও এতোটুকু ত্রুটি নেই, থাকলেও চোখে পড়েনা। পাশের রাজ্য থেকে এই শহরে পুজো কাটাতে আসা বন্ধু যখন বলে, “এমন একটা দুর্গাপুজো-তে মনে হয় বারবার আসি- একদম বাড়ি-র পুজো-র মতন কাটলো”… তখন এর কৃতিত্ব অবশ্যই প্রাপ্য মেমফিস পুজো-র পরিচালকদের। কত মানুষ আসে- সবটুকু আলোয় মোড়া, ভালোয় মেশানো। আড়ম্বর বা জাঁকজমক নয়, আন্তরিকতাই এই শহরের দুর্গোৎসবের মূল মন্ত্র। সবাই এগিয়ে আসেন হাসিমুখে পুজোর কাজে হাত লাগাতে- দোকান থেকে কেনা ফুল শুধু নয়, যে যার বাড়ির বাগান থেকে সেদিন সকালের সদ্য ফোটা ফুল নিয়ে আসে মায়ের অঞ্জলির জন্য।

পূজা-অর্চনায় মেমফিসের প্রবাসীরা। ছবি-এনওয়াইভয়েস২৪ ডটকম।

দুর্গাপুজো সত্যিই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য নজির আমাদের মেমফিসে। এই পুজোয় কোনো আলাদা ধর্ম নেই, কোনো আলাদা জাতও সেখানে বিষয় নয়- আসল কথা প্রত্যেকের অংশগ্রহণ। তাই পাশের রাজ্য থেকে ভোরবেলা গাড়ি চালিয়ে পৌঁছে যায় সদ্য কলকাতা থেকে আসা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তার আমেরিকান বন্ধুদের নিয়ে আর সবাই মিলে পুজো বাড়ির খিচুড়ি খেয়ে অনায়াসে মিশে যায় আমাদের সাথে! বছরের এই সময়টায় এদেশে এক প্রকার সাদা ঈষৎ বাদামি পম্পাস গ্রাস ফুল ফোটে। মা-র আগমনী বার্তা নিয়ে আসা শরতের কাশ ফুলের কোনো দূর সম্পর্কের আত্মীয় যেন। রাস্তার দু’ধার ভরে যায় এই ফুলে, দেখে মনে হয় “বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ”। আধ পৃথিবী দূরে থাকা ঢাকা-কলকাতার আত্মীয় স্বজনদের জন্য যখন মন কেমন করে শারদীয়ার সকালে, তখন পুজো বাড়ির সর্বাঙ্গীন আনন্দে সব ভুলে মনে হয়, দূর কোথায়, এই তো আছি, সবাই মিলেই, এক আকাশের নীচে!

আর আছে সন্ধ্যাবেলার আরতির পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান- ছোটো বড় সবাইকে নিয়ে গান- নাচ- নাটক, আরো কত কিছু।
“সেদিন ভোরে দেখি উঠে/
বৃষ্টিবাদল গেছে ছুটে,/
রোদ উঠেছে ঝিলমিলিয়ে–/
বাঁশের ডালে ডালে;/
ছুটির দিনে কেমন সুরে/
পুজোর সানাই বাজছে দূরে”/

আজকাল পুজো এলেই রবি ঠাকুরের “শিশু ভোলানাথ”-র এই লাইন গুলো খুব মনে পড়ে।

ছোটবেলায় পুজোর মাস দুয়েক আগে থেকেই জোর কদমে শুরু হয়ে যেত পুজোর চারদিনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি। গান, নাচ, আবৃত্তি, নাটক-একেবারে জমজমাট ব্যাপার। খুব উৎসাহ নিয়ে বাবা-মা’রা এতে অংশগ্রহণ করতেন, আমাদেরও উৎসাহ দিতেন।

পূজা-অর্চনায় মেমফিসের নতুন প্রজন্ম। ছবি-এনওয়াইভয়েস২৪ ডটকম।

আমাদের এমএসবিএর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বরাবরই সমৃদ্ধ হয় স্থানীয় বাঙালিদের উৎসাহী অংশগ্রহণে। তবে ২০১৮ সালে মেমফিসে আসার পর থেকে ছোটদের কোনো নাটক মঞ্চস্থ হতে দেখিনি। তাই ৭ বছর পর আবার নাটকের মঞ্চে ফিরে এসেছে শিশুদের কোলাহল। শ্রী দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার আর তাঁর অবিস্মরণীয় সৃষ্টি, শতাধিক বর্ষ প্রাচীন বাংলার রূপকথার অমর সংকলন, ঠাকুমার ঝুলি- আমাদের ফেলে আসা ছেলেবেলার এক টুকরো দলিল ! এই বছর পুজোয় শহরের ছোটরা ফিরিয়ে এনেছে আমাদের শৈশব, তাদের অভিনীত নাটক “অরুন-বরুন-কিরণমালা” র মাধ্যমে।

আজকের শিশুরা বড় হচ্ছে এক ভিন্ন বাস্তবতায়। তাদের শৈশব কাটে অনেকটাই চার দেয়ালের মাঝে, যেখানে ভার্চুয়াল জগতের হাতছানি অনেক বেশি আকর্ষণীয়। মোবাইল ফোন আর ভিডিও গেমসের দুনিয়ায় ডুবে থাকা এই শিশুদের অনেকেই ভুলে যাচ্ছে খোলা মাঠে ছুটে চলা, কিংবা দলবদ্ধ হয়ে কোনো সৃজনশীল কাজে মেতে ওঠার আনন্দ। গত দুটো মাস জুড়ে নাটকের মহড়ায় হৈচৈ করে মিলেমিশে কাজ করতে গিয়ে শিশুরা সৃজনশীলতার ডানা মেলে উড়তে শিখলো, একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের জন্ম হলো, চরিত্রের গভীরে প্রবেশ করতে গিয়ে তারা নিজেদের আবেগকে চিনতে শিখলো এবং অন্যের দৃষ্টিকোণ থেকে পৃথিবীকে দেখতে পেলো- এটাই আমাদের এ বছরের পুজোর সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।

(লেখক-জুলি বসু রায়, সাংস্কৃতিক কর্মী, এনআরবি ওয়ার্ল্ড ফ্রেন্ডশিপ ফোরামের সদস্য, মেমফিস, যুক্তরাষ্ট্র)

Facebook Comments Box

Posted ৮:৪৬ পূর্বাহ্ণ | মঙ্গলবার, ০৭ অক্টোবর ২০২৫

nyvoice24 |

Address
New York
Phone: 929-799-2884
Email: nyvoice24@gmail.com
Follow Us