নিউইয়র্কে মেয়র নির্বাচন ঘিরে তুমুল উত্তেজনা

মামদানিকে হারাতে মরিয়া ট্রাম্প স্লিওয়া সরে গেলেই ক্যুমো জিতবেন?

বিশেষ সংবাদদাতা   প্রিন্ট
বুধবার, ২২ অক্টোবর ২০২৫   সর্বশেষ আপডেট : ১:১৬ অপরাহ্ণ

মামদানিকে হারাতে মরিয়া ট্রাম্প স্লিওয়া সরে গেলেই ক্যুমো জিতবেন?

বাংলাদেশীদের নির্বাচনী সমাবেশে যোহরান মামদানি। ছবি-এনওয়াইভয়েস২৪ ডটকম।

নিউইয়র্ক সিটি মেয়র নির্বাচনে ডেমক্র্যাট (প্রথম মুসলিম প্রার্থী) যোহরান মামদানিকে ধরাশায়ী করতে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী কার্টিস স্লিওয়াকে সরে দাঁড়ানোর টোপ দেয়া ছাড়াও স্বতন্ত্র প্রার্থী (সাবেক স্টেট গভর্ণর ও যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক এটর্নী জেনারেল এবং গৃহায়ন মন্ত্রী) এ্যান্ড্রু ক্যুমো মামদানির বিরুদ্ধে ‘হারাম পন্থা অবলম্বন’র গুরুতর অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। মমদানি একদিকে ‘হালাল’ শব্দকে বাজারজাত করে মুসলিম ভোটারের নিরঙ্কুশ সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছেন, একইসাথে পতিতাবৃত্তিকে বৈধতা প্রদানের অঙ্গিকার করে স্ববিরোধী আচরণে লিপ্ত হয়েছেন বলে গুরুতর অভিযোগ উত্থাপন করেছেন ক্যুমো। বাস-সাবওয়ে ভাড়া ফ্রি করার কোন এখতিয়ার নেই সিটি মেয়রের। এক্ষেত্রেও মামদানি ভোটারদের সস্তা টোপ দিচ্ছেন। ধনীদের ট্যাক্স বৃদ্ধি এবং সিটির এপার্টমেন্টের ভাড়া বৃদ্ধি না করার অঙ্গিকার পূরণ করাও সম্ভব নয় মেয়রের একারপক্ষে। অথচ এমন অঙ্গিকার করে ভোট ব্যাংক মজবুত করেছেন মামদানি-এসব বক্তব্য দিয়ে ক্যুমো মুসলিম এবং গরিবের চেয়েও গরিব ভোটারের মধ্যে ভাঙন ধরানোর অহর্নিশ প্রয়াসের পাশাপাশি বিভিন্ন জরিপে তৃতীয় শীর্ষে থাকা রিপাবলিকান স্লিওয়াকে লোভ দেখাচ্ছেন নির্বাচনী দৌড় থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্যে। এ ধরনের বক্তব্য কয়েক সপ্তাহ আগে এসেছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে থেকেও। রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, নিউইয়র্ক সিটি মেয়র হিসেবে ক্যুমোই অধিকতর যোগ্য। ট্রাম্পের আহবানে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন বর্তমান মেয়র এরিক এডামস। এখোন স্লিওয়া সরে দাঁড়ালে রিপাবলিকান ভোটারের সকল ভোট ক্যুমো পাবেন এবং সিদ্ধান্তহীন ৯% ভোটারের বড় একটি অংশকেও কাছে টানতে সক্ষম হবেন বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন। এ ধরনের পর্যালোচনা, বিশ্লেষণের মধ্যেই সোমবার ২০ অক্টোবর ‘এএআরপি নিউইয়র্ক এবং গোথ্যাম পোলিং এ্যান্ড এনালাইটিক সার্ভে’ (অঅজচ ঘবি ণড়ৎশ ধহফ এড়ঃযধস চড়ষষরহম ্ অহধষুঃরপং ংঁৎাবু)প্রকাশিত এক জরিপে মামদানি ৪৩.২% সমর্থন নিয়ে ক্যুমোর তুলনায় ১৫% এগিয়ে আছেন। স্লিওয়ার পক্ষে রয়েছে ১৯.৪% ভোট। এই ১৯.৪% ক্যুমোর ২৮.৯% এর সাথে যোগ হলে মামদানির চেয়ে ৪% এগিয়ে যাবেন ক্যুমো-এটাকেই সর্বশেষ প্রয়াস দেখছেন মামদানি-বিরোধিরা। উল্লেখ্য, নিউইয়র্ক সিটির মোট ভোটারের ৬৭% এর অধিক ডেমক্র্যাট। অর্থাৎ ডেমক্র্যাটিক পার্টির মনোনয়ন লাভের পর মামদানির বিজয় নিয়ে ন্যূনতম ভাবনা থাকার কথা নয়। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রথম থেকেই মামদানিকে ‘সমাজতন্ত্রী ডেমক্র্যাট’, চরম বামপন্থি কিংবা ধনীদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করে আসছেন। ডেমক্র্যাটিক পার্টি থেকে মনোনয়নের দৌড়ে মামদানির কাছে হেরে যাবার পর ক্যুমো ‘স্বতন্ত্র প্রার্থী’ হিসেবে মাঠে নেমেছেন। এবং মামদানিকে ‘সমাজতন্ত্রী ডেমক্র্যাট’ হিসেবে চিহ্নিত করে উদারপন্থি ডেমক্র্যাটদের কাছে টানার চেষ্টা করছেন অবিরতভাবে। সর্বশেষ এই চেষ্টার সাথে যুক্ত করা হয়েছে ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক প্রচারনার মধ্যদিয়ে। এমনকি ক্যুমো ইতিহমধ্যেই বেশ কটি মসজিদ ও মন্দির পরিভ্রমণ করেছেন। স্টেট গভর্ণর হিসেবে ১১ বছর দায়িত্ব পালনকালে কখনোই ক্যুমো কোন মসজিদে যাননি কিংবা মুসলিম ভোটারদের বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন বলে শোনা যায়নি। মামদানি মুসলিম আমেরিকান হিসেবে নিউইয়র্ক সিটি মেয়র পদে ডেমক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পাবার পরই তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আসছে। ক্যুমোর টিম অভিযোগ করেছেন, চার বছর আগে থেকে মামদানি স্টেট এ্যাসেম্বলী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে কখনোই নিজেকে মুসলিম আমেরিকান হিসেবে পরিচয় দেননি কিংবা মসজিদ-মন্দিরেও দেখা যায়নি। তবে দু’বছর আগে ৭ অক্টোবর হামাস কর্তৃক ইসরায়েলিদের একটি উৎসবে আচমকা হামলা চালিয়ে ১২ শতাধিক তরুণ-তরুণীকে হত্যার পর ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের ওপর বর্বরোচিত হামলার প্রতিবাদে সোচ্চার হবার সময়েই মামদানি সর্বপ্রথম নিজেকে মুসলিম আমেরিকান হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সেই থেকে মামদানি হয়ে উঠেছেন উদারপন্থি ডেমক্র্যাট ছাড়াও কলেজ-ভার্সিটির তরুণ-তরুণীদের প্রিয় একজন ব্যক্তি হিসেবে। মামদানির এই মনোভাবের সমালোচনা করা হচ্ছে ‘জুইশ বিদ্বেষী’ হিসেবে উল্লেখ করে।

দক্ষিণ এশিয়ানদের নির্বাচনী সমাবেশে এ্যান্ডু্রৃ ক্যুমো। ছবি-এনওয়াইভয়েস২৪ ডটকম।

ক্যুমো জুইশ ভোটারের মধ্যে নিজের ভাঙন ধরিয়ে নিজের অবস্থানকে সুসংহত করার প্রয়াস চালাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, নিউইয়র্ক সিটির বাস-সাবওয়ে ভাড়া বৃদ্ধি বা কমানোর এখতিয়ার সিটি মেয়রের না থাকা সত্বেও মামদানি মিথ্যা অঙ্গিকার করছেন, ধনীদের ট্যাক্স বৃদ্ধি এবং শিশুদের সর্বজনীন চিকিৎসা-সেবার প্রক্রিয়া চালুর জন্যেও স্টেট গভর্ণর এবং স্টেট পার্লামেন্টের সহযোগিতার বিকল্প না থাকা সত্বেও মামদানি গলাবাজি করছেন বলে মন্তব্য করা হচ্ছে ক্যুমোর পক্ষ্য থেকে। গত রোববার কুইন্সের গুজরাটি সমাজ পার্টি হলে ক্যুমোর সমর্থনে দক্ষিণ এশিয়ানদের সমাবেশে মামদানির কঠোর সমালোচনা করেছেন মসজিদ, মন্দির, গীর্জার পৌরহিতরা। তারা সকলেই উল্লেখ করেছেন যে, কোন ধর্মেই পতিতাবৃত্তিকে বৈধতার সুযোগ নেই। অথচ মামদানি নিজেকে মুসলমান দাবি করেও নিউইয়র্ক সিটিতে পতিতাদের অবাধ বিচরণের অঙ্গিকার করছেন। এটা নিউইয়র্ক সিটির সামাজিক মূল্যবোধকে ধূলায় মিশিয়ে দেবে। নিউইয়র্ক সিটির রেল স্টেশনে এবং বেশ কটি এলাকায় দুর্বৃত্তদের হামলার ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বাড়লেও মামদানি পুলিশের বাজেট কাটছাটের অঙ্গিকার করে মূলত: আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে আর্ োনাজুক করা ইঙ্গিত দিয়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন ক্যুমোর সমর্থণে ঐ সমাবেশে বাংলাদেশী বক্তারাও। কুইন্স কম্যুনিটি বোর্ডের সদস্য এবং ডেমক্র্যাটিক পার্টির সংগঠক ফাহাদ সোলায়মান, ডেমক্র্যাটিক পার্টির ডিস্ট্রিক্ট লিডার দীলিপ নাথ নিজ নিজ বক্তব্যে নিউইয়র্ক সিটির বৃহত্তর স্বার্থে মামদানির পক্ষ থেকে ছেড়ে ক্যুমোর পক্ষে নামার পটভূমি ব্যাখ্যা করেছেন। তারা উভয়ে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান এবং জুইশদের প্রতি উদাত্ত আহবান জানিয়েছেন ৬৭ বছর বয়েসী ক্যুমোর দীর্ঘ অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে নিউইয়র্ক সিটিকে সকল মানুষের বসবাসের উপযোগী একটি স্থানে পরিণত করতেই ৪ নভেম্বরের নির্বাচনে ক্যুমোকে বিপুল বিজয় দানের জন্যে। ৩৪ বছর বয়েসী মামদানির কোন যোগ্যতাই নেই নিউইয়র্কের মত একটি সিটির মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালনের। এই সমাবেশে ক্যুমোর বিজয় ত্বরান্বিত করে সামনের দিনগুলোতে নিউইয়র্ক সিটির ক্ষুদ্র-মাঝারি ব্যবসাসহ স্বল্প আয়ের মানুষদের সার্বিক কল্যাণের পথ সুগম করার আহবানও উচ্চারিত হয় দক্ষিণ এশিয়ানদের পক্ষ থেকে।

চষে বেড়াচ্ছেন কার্টিস স্লিওয়া। ছবি-এনওয়াইভয়েস২৪ ডটকম।

শনিবার শুরু হবে এই নির্বাচনের আগাম ভোট গ্রহণের কর্মসূচি। তা চলবে ৪ নভেম্বর পর্যন্ত। নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসছে ততই জোরালো হচ্ছে প্রচারনা। পরস্পরকে আক্রমণাত্মক বক্তব্যও তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেও হুশিয়ারি দিয়েছেন যে, মামদানি বিজয়ী হলে নিউইয়র্ক সিটির ফেডারেল সহায়তা কর্তন করা হবে। সিটির আইন শৃঙ্খলার উন্নয়নে পাঠানো হবে ন্যাশনাল গার্ড। ক্যুমো জয়ী হলে উন্নয়নের সহযোগিতা বৃদ্ধির ইঙ্গিতও দিয়েছেন। যদিও নিউইয়র্কের রিপাবলিকান পার্টির শীর্ষ নেতারা মঙ্গলবারও গণমাধ্যমে উল্লেখ করেছেন যে রিপাবলিবান পার্টির ভোটারদের মনোবল অটুট রাখতেই দলীয় প্রার্থী সরানোর কোন সম্ভাবনা নেই। স্লিওয়া নিজেও ঘোষণা দিয়েছেন যে তিনি প্রার্থীতা থেকে সরবেন না। তাকে নাকি ১০ মিলিয়ন ডলার নগদ প্রদানের প্রস্তাবের পাশাপাশি সিটির গুরুত্বপূর্ণ একটি পদে চাকরির অফারও দেয়া হয়েছে নির্বাচন থেকে সরে যাবার শর্তে। কিন্তু তিনি শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকবেন বলে সিএনএন, নিউইয়র্ক টাইমসসহ শীর্ষস্থানীয় মিডিয়ায় উল্লেখ করেছেন।

Facebook Comments Box

Posted ৯:৫৬ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ২২ অক্টোবর ২০২৫

nyvoice24 |

Address
New York
Phone: 929-799-2884
Email: nyvoice24@gmail.com
Follow Us