আনন্দে উদ্বেলিত প্রবাসীরাও

মামদানির বিশাল বিজয়ের ঢেউ সারা আমেরিকায়

যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধি   প্রিন্ট
বুধবার, ০৫ নভেম্বর ২০২৫   সর্বশেষ আপডেট : ১০:৩৪ পূর্বাহ্ণ

মামদানির বিশাল বিজয়ের ঢেউ সারা আমেরিকায়

বিজয়-উৎসবে জোহরান মামদানি।

বিশাল ভোটের ব্যবধানে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থী অ্যান্ড্রু ক্যুমোকে পরাজিত করে ডেমক্র্যাট জোহরান মামদানি নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচিত হলেন। মামদানি (৩৪)হলেন এই সিটির প্রথম মুসলমান এবং প্রথম দক্ষিণ এশিয়ান ইমিগ্র্যান্ট মেয়র। এছাড়া তিনি হলেন নিউইয়র্কসহ যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সিটি সমূহে সবচেয়ে কম বয়েসী মেয়র। জোহরান মামদানি বিজয়ী হওয়ায় নিউইয়র্ক সিটির সীমানা পেরিয়ে সারা আমেরিকায় মুসলিম কম্যুনিটিতে আনন্দের জোয়ার বইছে। কারণ, মুসলমান হওয়ার কারণে মামদানিকে ট্রাম্প-সহ জাতীয় পর্যায়ের অনেক নীতি-নির্দ্ধারকের রোষানলে পড়তে হয়েছে। ডেমক্র্যাটিক পার্টির মনোনয়নের নির্বাচনে পরাজিত হয়ে নিউইয়র্কের স্টেট গভর্ণর অ্যান্ড্রু ক্যুমো স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মাঠে নেমে মামদানিকে অযোগ্য এবং কম্যুনিস্ট হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা চালিয়েছেন। শুধু তাই নয়, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্দেশে নিউইয়র্ক সিটির বর্তমান মেয়র এরিক এডামসও ক্যুমোর সমর্থনে নির্বাচন থেকে সরে দাড়িয়েছিলেন। ট্রাম্প প্রকাশ্যে ক্যুমোর প্রতি সমর্থন জানিয়ে ৩ নভেম্বর অর্থাৎ নির্বাচনের কয়েক ঘন্টা আগে বলেছেন যে, ‘আমি ক্যুমোর ভক্ত নই, কিন্তু যদি আমাকে একজন খারাপ ডেমক্র্যাট আর একজন কম্যুনিস্টের মধ্যে বেছে নিতে হয়, আমি সবসময় খারাপ ডেমক্র্যাটকেই বেছে নেব।’ ট্রাম্প আরো উল্লেখ করেছেন, ‘আমার পক্ষে নিউইয়র্কে প্রচুর অর্থ দেয়া কঠিন হবে। কারণ যদি সেখানে একজন কম্যুনিস্ট মেয়র হয়, তাহলে সেখানে পাঠানো অর্থ পুরোপুরি অপচয় ছাড়া কিছুই নয়।’ এভাবেই মামদানিকে আক্রমণের পাশাপাশি সহজ-সরল ভোটারদের মামদানির ব্যাপারে নেতিবাচক ধারণা তৈরীর অহর্নিশ প্রয়াস চালানো সত্বেও নিউইয়র্কের ভোটাররা বিভ্রান্ত হননি বলে সকলে মনে করছেন। আর এই ফলাফলের মধ্যদিয়ে সামনের বছরের মধ্যবর্তী নির্বাচনের ব্যাপারেও ভোটারেরা একটি ইঙ্গিত দিলেন। কারণ, ৪ নভেম্বর মঙ্গলবার একইসাথে ভার্জিনিয়া এবং নিউজার্সি স্টেট গভর্ণর পদের নির্বাচনেও বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছেন ডেমক্র্যাটিক পার্টির দুই নারী প্রার্থী। কংগ্রেসওম্যান মিকাই শেরিল নিউজার্সির গভর্ণর হিসেবে জয়ী হওয়ার মধ্যদিয়ে এই স্টেটকে আবারো ডেমক্র্যাটদের কব্জায় আনা সম্ভব হলো। একইভাবে আবিগাইল স্প্যানবারগার ভার্জিনিয়ার স্টেট গভর্ণর হিসেবে জয়ী হওয়ায় ট্রাম্পের রিপাবলিকান পার্টির প্রতি সাধারণ ভোটারের অনীহার ব্যাপারটি দৃশ্যমান হলো। আর বিজয়ের এই ধারা সামনের বছরের নভেম্বরের মধ্যবর্তী নির্বাচনকেও প্রভাবিত করবে বলে ডেমক্র্যাটরা আশা করছেন। এভাবেই বামপন্থি ধারায় আমেরিকানদের সমর্থনের জোয়ার তৈরী হচ্ছে বলে অনেকের ধারণা।

নিউইয়র্ক সিটির বহুল আলোচিত এই নির্বাচনে সর্বাধিকসংখ্যক ভোটার অংশ নিয়েছেন। ২০ লাখ ভোটের ৪৯.৬% পেয়েছেন মামদানি। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বি ক্যুমো পেয়েছেন ৪১.৬%। অপরদিকে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী কার্টিস স্লিওয়া পেয়েছেন ৭.৯% ভোট। সপ্তাহখানেক আগে শুরু হওয়া আগাম ভোটের লাইনেও তরুণ ভোটারের সংখ্যাধিক্য ছিল এবং সে সময়েই মামদানির বিজয় বার্তা সকলকে আন্দোলিত করা অবস্থায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সরাসরি নিউইয়র্কের ভোটারদের প্রতি হুমকি উচ্চারণ করেছিলেন যে, মামদানির মত বামপন্থি কেউ যদি মেয়র হয় তাহলে ফেডারেলের সকল সহায়তা হ্রাস করা হবে। প্রয়োজনে সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হবে সিটির সার্বিক পরিস্থিতির উন্নয়নে এবং অবৈধ অভিবাসীদের ধর-পাকড়ের জন্যে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এমন হুমকি-ধমকি পাত্তা না দিয়ে মুসলিম ভোটারসহ তরুণ ভোটারেরা শেষ পর্যন্ত সরব থাকায় মামদানির বিজয় নিশ্চিত হলো বলেও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা মন্তব্য করেছেন।

মামদানির বিজয়ে বাংলাদেশীদের বড় একটি অংশ বেশ সরব ছিলেন শেষ পর্যন্ত। মার্কিন রাজনীতিতে প্রবাসীদের এমন সম্পৃক্ততার ঘটনা আগে কখনো দেখা যায়নি। স্টেট এ্যাসেম্বলীম্যান হিসেবে মামদানির ভ’মিকা, গাজায় ইসায়েলের আগ্রাসনের প্রতিবাদ, অভিবাসীদের সুরক্ষায় নিজের সুদৃঢ় অবস্থানের পাশাপাশি ট্যাক্সি ড্রাইভারসহ খেটে খাওয়া মানুষের কল্যাণে সর্বদা তৎপর থাকায় প্রবাসী বাংলাদেশীদের হুদয়ের মনিকোঠায় ঠাঁই করে নিতে সক্ষম হয়েছেন মামদানি-এমন মন্তব্য করেছেন ‘বাংলাদেশীজ ফর মামদানি’র কো-চেয়ার গিয়াস আহমেদ। এই জোটের চেয়ারপার্সন ডেমক্র্যাটিক পার্টির ডিস্ট্রিক্ট লিডার এ্যাট লার্জ এটর্নী মঈন চৌধুরী প্রবাসী ভোটারদের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন শত প্রতিক’লতা সত্বেও ব্যালট যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ায়। একইসাথে অভিনন্দন জানিয়েছেন জোহরান মামদানিকে। উল্লেখ্য, মামদানির জন্যে মাঠে থাকা ৯০ হাজার স্বেচ্ছাসেবকের মধ্যে ৩ হাজার জন পাকিস্তানী এবং বাংলাদেশীর সংখ্যাও ছিল দুই হাজারের মত। সাউথ এশিয়ান ভোটারের মধ্যে যারা ব্যালট যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন তার ৫৮% বাংলাদেশী। মামদানির পক্ষে ছিলেন না ভারতীয় আমেরিকানের বড় একটি অংশ। তারা সাপোর্ট দিয়েছেন কুমোকে।

ফলাফল নিশ্চিত হবার পর নিউইয়র্ক সিটির জ্যাকসন হাইটস, জ্যামাইকা, ব্রঙ্কসের পার্কচেস্টার, ব্রুকলীনের চার্চ-ম্যাকডোনাল্ডে প্রবাসীরা আনন্দ-উৎসব করেছেন। সকলেই বলাবলি করছেন যে, মামদানির বিজয় হচ্ছে অভিবাসীগণের বিজয়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অ-আমেরিকান কর্মকান্ড রুখে দিতেও একইভাবে সকলকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।

১ জানুয়ারি শপথ গ্রহণের পরই ১১১ তম মেয়র হিসেবে অধিষ্ঠিত হবেন মামদানি।

মামদানির এই জয় শুধু নিউইয়র্ক নয়, বরং মার্কিন রাজনীতিতেও প্রগতিশীল ধারার নতুন অধ্যায় সূচনা করেছে। ব্রুকলিনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনী সমাবেশে উচ্ছ্বসিত সমর্থকদের উদ্দেশে মামদানি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে শ্রমজীবী মানুষকে ধনী ও ক্ষমতাবানরা বোঝাতে চেয়েছে যে ক্ষমতা তাদের হাতে নয়। কিন্তু গত এক বছরে আপনারা প্রমাণ করেছেন, আপনাদের হাতেই সেই ক্ষমতা। আজকের এই জয় অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। তিনি বলেন, আমরা একটি রাজনৈতিক বংশের পতন ঘটিয়েছি। প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যান্ড্রু কুমোকে উদ্দেশ করে মামদানি বলেন, আমি তার ব্যক্তিজীবনের জন্য শুভকামনা জানাই। তবে আজকের পর তার নাম আর উচ্চারণ করতে চাই না। নিজের নীতিমালা তুলে ধরে মামদানি বলেন, এই নির্বাচনে জনগণ ‘পরিবর্তনের পক্ষে ভোট দিয়েছে’ এবং এমন এক শহরের পক্ষে রায় দিয়েছে, যেখানে সবাই বসবাস করতে পারবে। তিনি নিউইয়র্কের বৈচিত্রময় জনগোষ্ঠীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান । ইয়েমেনি মুদি দোকান মালিক, সেনেগালিজ ট্যাক্সিচালক, উজবেক নার্স এবং ইথিওপীয় ‘আন্টি’-দের কথা উল্লেখ করে বলেন, এই শহর আপনাদের হাতেই গড়ে উঠেছে। বক্তৃতায় মামদানি আবেগাপ্লুত হয়ে তার বাবা-মা ও স্ত্রী রামার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, আজ আমি যা হয়েছি, তা বাবা-মায়ের জন্যই।

তিনি আরও বলেন, এই বিজয় এক লাখেরও বেশি স্বেচ্ছাসেবকের, যারা এই প্রচারকে এক অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে রূপ দিয়েছে। আপনাদের কারণেই আমরা আবার এমন এক শহর গড়ব, যেখানে শ্রমজীবী মানুষ বাঁচতে পারবে, ভালোবাসতে পারবে।

শেষে মামদানি বলেন, নিউইয়র্ক, আজ এই মুহূর্তটা গভীরভাবে অনুভব করো। আমরা বহুদিন শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় ছিলাম, পরাজয়ের আশঙ্কায় নিঃশ্বাস আটকে রেখেছিলাম। আজ আমরা আবার মুক্তভাবে শ্বাস নিচ্ছি-এক নবজাগ্রত শহরের বাতাসে।

যা বললেন ট্রাম্প
মেয়র নির্বাচনে জোহরান মামদানির ঐতিহাসিক বিজয়ের পর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি বলেছেন, ব্যালটে তার নাম ছিল না এবং চলমান অচলাবস্থার কারণে রিপাবলিকানদের এমন ফলাফল। ট্রাম্প তার সামাজিক মাধ্যম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ লিখেছেন, ‘ব্যালটে ট্রাম্প ছিল না, আর সরকারি অচলাবস্থা-এই দুই কারণেই রিপাবলিকানরা আজকের নির্বাচনে হেরেছে।’ তবে তিনি কোন জরিপ সংস্থা বা তথ্যসূত্রের ভিত্তিতে এই দাবি করেছেন, তা স্পষ্ট করেননি। এর আগে ট্রাম্প মামদানিকে ‘কমিউনিস্ট’ আখ্যা দিয়ে তিনি বিজয়ী হলে তা নিউইয়র্কের জন্য হুমকি বলে মন্তব্য করেছিলেন।

এই নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটরা যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বড় জয় পেয়েছে। নিউজার্সি ও ভার্জিনিয়ার গভর্নর নির্বাচন এবং নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচনসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়েছে তারা।

জোহরান মামদানির সাথে ওসমান চৌধুরী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা লাবলু আনসার। ছবি-এনওয়াইভয়েস২৪ ডটকম।

মা মীরা নায়ারের প্রত্যাশা
মার্কিন রাজনীতিতে বামঘেঁষা ডেমোক্র্যাট বলে পরিচিত জোহরান মামদানি। আফ্রিকা মহাদেশের উগান্ডায় জন্ম হলেও তিনি ভারতীয় ইমিগ্র্যান্ট। ভারতীয় চিত্রপরিচালক মীরা নায়ারের পুত্র মামদানি। তার পিতা উগান্ডার খ্যাতনামা লেখক অধ্যাপক মাহমুদ মামদানি। ছেলের সাফল্যে আবেগতাড়িত মা মীরা। মামদানি ভোটের প্রচারের সময় জীবন ধারণের খরচ কম করার আশ্বাস দিয়েছিলেন। এমনকি, দীর্ঘ দিন শহরে যাঁরা ভাড়াবাড়িতে রয়েছেন তাদের ভাড়া মওকুফের কথাও বলেন। মনে করা হচ্ছে, মীরা-পুত্রের সেই আশ্বাসেই ভরসা রেখেছেন নিউইয়র্কবাসী। ভোটের ফল প্রকাশ্যে আসার পর মামদানির ওয়েবসাইট থেকে লেখা হয়েছে, নিউইয়র্কে থাকার খরচ বড্ড বেশি। মামদানি এ বার খরচ কমিয়ে জীবনধারণকে অনেক সহজ করে তুলবেন।

সাধারণ মানুষকে সেই ভরসা বজায় রাখার উপদেশ দিলেন মা মীরা। পরিচালক বলেন, আমি আমার ছেলের সাহস ও বচনভঙ্গিমা দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছি। ওর যেটা আমার ভাল লাগে তা হল, ও এই বিশ্বের বিভিন্নতাকে দ্ব্যর্থহীনভাবে গ্রহণ করেছে। ও যে আশা দেখিয়েছে, তাতে আশাবাদী আমি। এই বিশ্বকে দেখার একটা দূরদৃষ্টি রয়েছে ওর মধ্যে। আর সেটা ক্ষমতার লোভ নয়। মানুষের সাম্য, ন্যায়বিচার ও খেটে খাওয়া মানুষের পক্ষে ও সবসময়ে রয়েছে।

মা এবং স্ত্রীকে পাশে নিয়ে জোহরান মামদানি তার বিজয়-ভাষণ দেন। ছবি-এনওয়াইভয়েস২৪ ডটকম।

নিউজার্সির গভর্নর হলেন মিকি শেরিল
নিউজার্সির স্টেট গভর্নর নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী মিকি শেরিল। জয়লাভের পর তিনি ভোটারদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্য এক্স -এ দেওয়া এক পোস্টে তিনি লিখেছেন, নিউজার্সি এই মহান অঙ্গরাজ্যের ৫৭তম গভর্নর হওয়ার জন্য আপনাদের আস্থা অর্জন করা আমার জীবনের সর্বোচ্চ সম্মান। চার মেয়াদের কংগ্রেস সদস্য শেরিল আরও বলেন, আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি আমি আপনাদের কথা শুনব, সাহসিকতার সঙ্গে নেতৃত্ব দেব।

Facebook Comments Box

Posted ৯:১৯ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ০৫ নভেম্বর ২০২৫

nyvoice24 |

Address
New York
Phone: 929-799-2884
Email: nyvoice24@gmail.com
Follow Us