বিডিআর হত্যাকান্ডের অজানা তথ্য উদঘাটনে তদন্ত কমিশন সফল হবে: আশা জেনারেল মইনের

নিজস্ব প্রতিবেদক   প্রিন্ট
শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪   সর্বশেষ আপডেট : ৬:২৩ পূর্বাহ্ণ

বিডিআর হত্যাকান্ডের অজানা তথ্য উদঘাটনে তদন্ত কমিশন সফল হবে: আশা জেনারেল মইনের

জেনারেল মইন ইউ আহমেদ। ছবি-সংগ্রহ।

বিডিআর হত্যাকান্ডের সত্যিকারের নেপথ্য কাহিনী আজো কেউ জানতে পারেনি। কীভাবে কার স্বার্থে এবং কার মদদে ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানী ঢাকার পিলখানায় তৎকালিন বিডিআর সদর দপ্তরে নির্মম ও নৃশংস হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছিল তা এতদিন শুধু ক্ষমতাসীনদের মুখে উচ্চারিত হয়েছে। ভিকটিমরাও রহস্যজনক কারণে সরব হননি। ফলে প্রকৃত সত্য জানতে সারা বাংলার মানুষের কৌতুহলের অন্ত নেই। সেই তাগিদে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে ঘটনা তদন্তে একটি কমিশন গঠিত হয়েছে। সেই কমিশনের প্রথম বৈঠক শেষে কমিশনের প্রধান এ এল এম ফজলুর রহমান বৃহস্প্রতিবার গণমাধ্যমে বলেছেন যে, হত্যাকান্ডের নেপথ্যে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র যদি থেকে থাকে, তা চিহ্নিত করে জাতির সামনে উপস্থাপনে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করা হবে না। একই মনোভাবের প্রতিধ্বনি ঘটেছে সে সময়ের সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদের কন্ঠেও। ২৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় (বাংলাদেশ সময় শুক্রবার সকাল) ফ্লোরিডা থেকে টেলিফোনে নিউইয়র্কে এ সংবাদদাতাকে জেনারেল মইন সন্তোষের সাথে জানান, জাতির প্রত্যাশা পূরণে গঠিত কমিশনের তদন্তে প্রকৃত তথ্য উদঘাটিত হবে বলে আশা করি। কারণ, ঐ হত্যাকান্ডের ভিকটিমরা ছিলেন বাংলাদেশের চৌকষ অফিসারদের অন্যতম। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে ধ্বংসের অভিপ্রায়ে ঐ হত্যাযজ্ঞ চালানো হতে পারে। তাই সঠিক তদন্তের প্রত্যাশা ছিল সর্বমহলে। উল্লেখ্য, বিডিআর হত্যাকান্ড নিয়ে এই সেনা প্রধান ‘পিলখানায় পৈশাচিক হত্যাকান্ড’ শিরোনামে একটি বই লিখেছেন এবং তা শিগগিরই প্রকাশিত হবে। যেখানেও অজানা অনেক তথ্য সন্নিবেশিত আছে বলে উল্লেখ করেন জেনারেল মইন। সাবেক এই জেনারেল তদন্ত কমিশনকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল মইন জানান, চিকিৎসার প্রয়োজনে ফ্লোরিডায় বাস করছি। এ নিয়েও নানাজনে নানা কথা রটাচ্ছেন। উদ্ভট কিছু মন্তব্যও পাওয়া যাচ্ছে। এগুলো আমাকে ব্যথিত করে। জেনারেল মইন বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যিনি আগে গঠিত কমিশনের প্রধান ছিলেন তার সাথে আমার ইতিমধ্যেই কথা হয়েছে। এছাড়া আমি বিডিআর হত্যাকান্ডের ব্যাপারে একটি ভিডিও-বক্তব্য ইউটিউবে ৬ সেপ্টেম্বর আপলোড করেছি, সেখানেও অনেক কিছু রয়েছে। তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) মইন ইউ আহমেদ বলেছেন, হত্যাকান্ডটি নিয়ে ১৫ বছরে শুধু বিগত সরকারের কথা শুনতে হয়েছে। প্রকৃত ঘটনা অনেক কিছুই জানা নেই। জনগণও জানতে পারেনি। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার থাকাকালে তিনি কথাগুলো বলতে চেয়েও পারেননি। তবে তিনি মনে করেন, তখন সেনাবাহিনী কী ভূমিকা নিয়েছিল এবং ঘটনা কী ছিল, সে সম্পর্কে মানুষের জানা উচিত। বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তিনি এখন ঘটনাগুলো তুলে ধরতে পারছেন। উল্লেখ্য, বিডিআরের কথিত ঐ বিদ্রোহে ওই সময় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ মোট ৭৪ জনকে হত্যা করা হয়। “বাংলাদেশ আমার’’ শীরোনামে ২৯ মিনিটের ঐ ভিডিও বার্তার শুরুতেই গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে তিনি সেদিনের ঘটনা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় সেনাবাহিনী ও তৎকালীন সেনাপ্রধানের ভূমিকা অনেকের জানা নেই। অনেকে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করছেন। ভূমিকা কী ছিল, তা তিনি জানাতে চান। ৫ আগস্ট স্বৈরাচার সরকারের পতনের পর বিডিআর বিদ্রোহের কিছু প্রত্যক্ষদর্শীগণ এবং পরিবারবর্গ তাদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। আমিও আমার ভূমিকা আপনাদেরকে জানাতে চাই। বিডিআর বিদ্রোহ দমনে সেনাবাহিনী তথা সেনা প্রধানের ভূমিকার কথা অনেকের জানা নেই এবং তারা নেতিবাচক ধারণা পোষণ করছেন। বিডিআর হত্যাকান্ডের ওপর একটি বই আমি লিখেছি যা সহসাই প্রকাশ করা হবে।

সাবেক এই জেনারেল উল্লেখ করেন, বিদ্রোহের ১৫ বছর ধরে আমরা শুধু ক্ষমতাসীন সরকারের কথা শুনেছি এবং প্রকৃত ঘটনার অনেক কিছু আমাদের জানা নেই। সে সময় সরকার একটি তদন্ত আদালত গঠন করে এবং সেনাবাহিনীও একটি তদন্ত আদালত গঠন করে। আমি সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে আদেশ দিয়েছি তদন্ত আদালত গঠনের। তখোন আমাকে বলা হলো যে, সরকার যখোন তদন্ত আদালত গঠন করছে তখোন সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে প্রয়োজনটা কী। প্রতি উত্তরে আমি বললাম একই ঘটনায় বিভিন্ন স্তরে তদন্ত আদালত হতে পারে। যদি একটি ব্যাটালিয়নে একটি ঘটনা ঘটে তবে ব্যাটেলিয়ন কমান্ডার তদন্ত আদালত করবেন। ব্রিগেড কমান্ডার করবেন, প্রয়োজন হলে ডিপ কমান্ডারও করতে পারেন। তদ্রুপ আমিও আমার ৫৭ জন অফিসার হারিয়েছি, আমি মনে করি আমার দায়িত্ব আমার জানার প্রয়োজন আছে, পুরো সেনাবাহিনীর জানার প্রয়োজন আছে কেন হত্যা করা হলো এবং এই হত্যাকান্ডের কারণ আমাকে বের করতে হবে। এরপর আর কোন উচ্চবাচ্য সরকার থেকে আসেনি। তবে এই তদন্ত আদালত করতে যেসব জিনিষ প্রয়োজন তা সরকার থেকে আমরা পাইনি। তদন্ত আদালতের নেতৃত্ব দিয়েছেন লে. জেনারেল জাহাঙ্গির আলম চৌধুরী এবং তার সাথে অন্যান্য মেম্বাররা ছিলেন। তাকে যে টার্মস অ্যান্ড রেফারেন্স দেয়া হয়েছে তিনি তা সম্পন্ন করতে পারেননি, কারণ হলো যারা এর সাথে জড়িত ছিল তারা মোস্টলি জেলে ছিল, তাদেরকে সম্মুখে আনা সম্ভব হয়নি। তাদেরকে প্রশ্ন করা সম্ভব হয়নি এবং যারা বিভিন্ন আলোচনায় যুক্ত ছিল তাদের বক্তব্যও নেয়া সম্ভব হয়নি। সেনাবাহিনীর তদন্ত চলাকালিন জেনারেল জাহাঙ্গির (বর্তমান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা) বেশ কবার আমার কাছে এসেছেন, এবং ওনার প্রবলেমগুলো তুলে ধরেছেন। এখোন আমি নিশ্চিত যে, এবার উনি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হয়ে তদন্ত আদালত, প্রয়োজন হলে পুনরায় তদন্ত করে সম্পূর্ণ তথ্য বের করে, কারা জড়িত দেশে এবং বাহিরে তা উদঘাটনে সক্ষম হবেন। আমি জানাতে চাই যে এই নতুন সরকার যখোন গঠিত হয় তখোনই আমি জেনারেল জাহাঙ্গিরকে টেলিফোন করি এবং ওনাকে রিকুয়েস্ট করি যাতে উনি এই তদন্ত আদালতের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেন। জনগণ জানুক কারা এর সাথে জড়িত, এবং কী অপরাধে চৌকষ ৫৭ জন অফিসারকে খুন করা হলো।

মইন ইউ আহমেদ বলেন, কী ঘটেছিল সেদিন পিলখানায়?
সেনাবাহিনীর অব্যবহৃত কিছু অস্ত্র (৮১ মিলিমিটার মর্টার, যেগুলো সেনাবাহিনী ব্যবহার করে না) বিডিআরকে দেওয়া নিয়ে বাহিনীটির তৎকালীন মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের (হত্যাকান্ডে নিহত) সঙ্গে ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সকালে কথা হয়। তিনি অস্ত্রগুলো নিতে রাজি হন। তখন পর্যন্ত বিদ্রোহ সম্পর্কে তিনি (বিডিআরের ডিজি) কিছুই জানতেন না বলেই সাবেক সেনাপ্রধানের বিশ্বাস। যতি জানতেন তাহলে নিশ্চয়ই তিনি আমাকে তা অবহিত করতেন।

জিএসপিসির একটি বৈঠকে থাকার সময় ওই দিন সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ‘আমার প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি কর্নেল ফিরোজ সভাকক্ষে প্রবেশ করেন এবং আমাকে কানে কানে বলেন, স্যার পিলখানায় গন্ডগোল হচ্ছে। আপনার দিকনির্দেশনা প্রয়োজন।’ মনে মনে ভাবলাম-একটু আগেই তো ডিজি বিডিআরের সাথে কথা হলো। হঠাৎ কী হলো। সে যাই হোক।
মইন ইউ আহমেদ বলেন, তখন ওই সভা স্থগিত করে সহকর্মীগণকে সঙ্গে নিয়ে আমার অফিসে এলাম। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও বিডিআরের ডিজির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করি। এডিসি ক্যাপ্টেন জুনায়েদকে নির্দেশ দেই টেলিফোনে যুক্ত করার জন্য। তাঁদের ফোন ধারাবাহিকভাবে ব্যস্ত ছিল। তাৎক্ষণিক সংযোগ পাওয়া সম্ভব হয়নি। সামরিক গোয়েন্দারা তখন পরিস্থিতি সম্পর্কে জানান। কী ঘটছে পিলখানায় তা জানানো হলো।

পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করে সময় বাঁচাতে কারও নির্দেশ ছাড়াই সেনাবাহিনীর ৪৬ ইন্ডপিন্ডেন্ট পদাতিক ব্রিগেডকে অপারেশনের জন্য প্রস্তুত হতে নির্দেশ দেই। তারা তাৎক্ষণিকভাবে যুদ্ধপ্রস্তুতি শুরু করে, যার নামকরণ করা হয় ‘অপারেশন রিস্টোর অর্ডার’। গৃহিত পদক্ষেপ সম্পর্কে পিএসও এফডি জেনারেল মবিনকে অবহিত করি।

সকাল ৯টা ৪৭ মিনিটে বিডিআরের ডিজিকে ফোনে পাওয়া গেল। আমি ওনাকে বল্লাম কী হয়েছে। তিনি এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেন। তিনি (মহাপরিচালক) বলেন, দরবার চলাকালীন দুজন সশস্ত্র সৈনিক দরবার হলে প্রবেশ করে। একজন আমার (ডিজির) পেছনে এসে দাঁড়ায় এবং অজ্ঞান হয়ে যায়। অপরজন দরবার হল ক্রস করে বাইরে চলে যায়। তার পরপরই বাইরে থেকে গুলির শব্দ আসে। গুলির শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গে দরবার হলে উপস্থিত সৈনিকবৃন্দ গন্ডগোল শুরু করে দেয়। এবং তারা দাঁড়িয়ে যায়। দরবার হল থেকে বের হয়ে যায়।

মইন ইউ আহমেদ বলেন, ‘মনে হলো সব পরিকল্পনার অংশ। পরিকল্পনা অনুযায়ী বাস্তবায়িত হচ্ছে। ডিজি আরো বলেন, আমি সেক্টর কমান্ডার এবং ব্যাটেলিয়ন কমান্ডারকে পাঠিয়েছি তাদের ফিরিয়ে আনার জন্য, যাতে করে পুনরায় দরবার শুরু করা যায়। তিনি আশা করেন যে সহসাই দরবার শুরু করতে পারবেন। আমি তাকে জানাই যে, পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য ৪৬ ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইনফ্র্যান্ড ব্রিগেডকে প্রস্তুত হওয়ার জন্য আদেশ দিয়েছি। এবং সহসাই তারা পিলখানার উদ্দেশ্যে যাত্রা করবেন।

মইন ইউ আহমেদ উল্লেখ করেন যে, ‘অনেকে মনে করেন, ডিজি বিডিআর সাহায্যের জন্য আমাকে কল করেছিলেন। এটা সত্য নয়। আমি বিডিআর ডিজিকে ফোন করি এবং আমরা কী ব্যবস্থা নিচ্ছি, তা ওনাকে জানিয়ে দিই। ওনি আমাকে ফোন করেননি।’

ওই দিন সকাল ৯টা ৫৪ মিনিটে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মুঠোফোনে পেলাম। ‘এর মধ্যেই তিনি (শেখ হাসিনা) বিডিআর বিদ্রোহ সম্পর্কে অনেক তথ্য পেয়ে গিয়েছিলেন। এ সময় আমি তাঁকে অপারেশনের কথা জানালে তিনি জানতে চান, কতক্ষণ সময় লাগবে ব্রিগেডকে তৈরি করতে? আমি বললাম, সাধারণত ছয় ঘণ্টা লাগে। তবে তাড়াতাড়ি করে দুই ঘণ্টার মধ্যে তৈরি করা যায়।’

৪৬ ব্রিগেডকে পিলখানায় যাওয়ার অনুমতি শেখ হাসিনা দিয়েছিলেন বলে জানান মইন ইউ আহমেদ। ব্রিগেডটি এক ঘণ্টার মধ্যে যাত্রা শুরু করে উল্লেখ করে জেনারেল মইন বলেন, ৪৬ ব্রিগেডের তৎকালীন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাকিমের নেতৃত্বে ১০ জন কর্মকর্তা ও ৬৫৫ জন সৈনিক পিলখানার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। সকাল সাড়ে ১০টায় ব্রিগেডের অগ্রবর্তী দল জাহাঙ্গীর গেট অতিক্রম করে। এত কমসময়ের মধ্যে প্রস্তুত হয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল এটা বিরল কৃতিত্বের উদাহরণ।

ওদিকে বিদ্রোহীরা বিডিআর গেটগুলোর সামনে আক্রমণ প্রতিহত করতে বিভিন্ন ভারী অস্ত্র মোতায়েন করে বলে উল্লেখ করেন মইন ইউ আহমেদ। তিনি বলেন, বেলা ১১টায় ৪৬ ব্রিগেডের প্রথম গাড়িটি পিলখানার মেইন গেটের কাছাকাছি পৌঁছালে বিদ্রোহীরা একটি পিকআপ লক্ষ্য করে রকেট হামলা চালায়। এতে চালক ঘটনাস্থলেই মারা যান। চালকের পাশে বসা একজন গুরুতর আহত হন।

সাবেক সেনাপ্রধান বলেন, আমার নির্দেশ অনুযায়ী ১০টা ৩৫ মিনিটের দিকে আমার অফিস থেকে বিডিআরের মহাপরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। তবে তা সম্ভব হয়নি। হয়তো এর আগেই তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল। তিনি তৎকালীন লেফটেন্যান্ট কর্নেল শামসের বরাত দিয়ে বলেন, শামসের ধারণা অনুযায়ী, সাড়ে ১০টা থেকে ১১টার মধ্যেই বেশীরভাগ অফিসারকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সেনাবাহিনীর ব্রিগেড পৌঁছায় ১১টার পরে। তার মানে আমরা পৌঁছানোর আগেই বেশীর ভাগ হত্যাকান্ড ওরা করে ফেলেছে।

বিডিআর হত্যাকান্ড নিয়ে লেখা বইয়ের প্রচ্ছদ-যা শীঘ্রই প্রকাশিত হবে।

মইন ইউ আহমেদ বলেন, ক্যাপ্টেন শফিকের নেতৃত্বে ৩৫৫ জন র‌্যাব সদস্য পিলখানায় পৌঁছান ১০টার আগেই। এ সময় তিনি তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে পিলখানায় প্রবেশের অনুমতি চাইলেও তা পাননি। তাকে যদি অনুমতি দেয়া হতো, (বিদ্রোহীরা তখোনও পুরোপুরি সংঘটিত হতে পারেনি, কোন ক্ষয়-ক্ষতিও করতে পারেনি, ) তাহলে তিনি সহজেই ওদেরকে কনটেন্ট করতে পারতেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা বিদ্রোহীদের অতি সহজে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতো।

সাবেক এই সেনাপ্রধান উল্লেখ করেন, ১১টা ৪৫ মিনিটের দিকে পিএসও এএফডি (প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ) তাঁকে জানান, সরকার রাজনৈতিকভাবে এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে। বিদ্রোহীরা দাবি করেছে যে, কোনো আলোচনার আগে সেনাবাহিনীকে এই এলাকা থেকে চলে যেতে হবে। তাই সরকার আদেশ করেছিল, সেনাবাহিনীর সদস্যদের দৃষ্টির আড়ালে চলে যেতে হবে। অন্তত দুই কিলোমিটার উত্তরে চলে যাওয়ার জন্য বলা হয়। সমঝোতা না হলে তখন সামরিক অভিযান পরিচালনা করা হবে।

আনুমানিক বেলা ১২টায় পিএসও ফোন করে জরুরি ভিত্তিতে আমাকে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যমুনায় যেতে বলেন। তিনি কেনইবা আমাকে যমুনায় যেতে বললেন। কারণ ঐ সময় প্রতিটা ক্ষণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যা হোক আমি যমুনায় রওয়ানা হলাম। মইন ইউ আহমেদ বলেন, বেলা একটার দিকে সাদা পতাকা নিয়ে প্রাক্তন প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক ও হুইপ মির্জা আজম আলোচনার জন্য পিলখানায় যান। এরই মধ্যে সরকার থেকে বলা হলো, সেনাবাহিনী পিলখানার প্রধান ফটক এলাকায় থাকবে। র‌্যাব ও পুলিশ আরও দুটি এলাকায়। ডেইরি ফার্ম থাকা এলাকাটি অরক্ষিত ছিল।

মইন ইউ আহমেদ বলেন, যমুনায় গিয়ে অনেক লোককে দেখি, লোকে লোকারন্য, হাঁটার জায়গা নেই। যাঁদের কোনো কাজ ছিল না। কৌতূহলবশত এসেছিলেন। মন্ত্রিসভা বৈঠক করছিল। কোনো সিদ্ধান্ত আসছিল না। আমি ভেবেছিলাম, সেখানে পৌঁছার সংবাদ জেনে তিনি আমাকে ভেতরে ডেকে নেবেন। কিন্তু তা করা হলো না। বেলা ২টার পর খবর এলো, পিলখানা থেকে একজন অফিসার পালিয়ে যমুনায় এসেছে। আমি তার কাছে ছুটে গেলাম। জানলাম যে বেশ কিছু অফিসারকে হত্যা করা হয়েছে। তবে ডিজি বিডিআর সম্পর্কে তিনি নিশ্চিত নন। সে সময়েই নিশ্চিত হলাম যে বিডিআর বিদ্রোহীরা নিরপরাধ অফিসারদেরকে হত্যা করেছে।

মন্ত্রিসভার পর আরেকটি ছোট বৈঠক করে তিন বাহিনীর প্রধানদের শেখ হাসিনা ডাকেন বলে উল্লেখ করে মইন ইউ আহমেদ বলেন, তিনি যাওয়ার দেড় ঘণ্টা পরে বিমান ও নৌবাহিনীর প্রধান যমুনায় এসেছিলেন। শেখ হাসিনা আমাদেরকে বললেন যে, রাজনৈতিকভাবে সমস্যাটি সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জাহাঙ্গীর কবির নানক ও মির্জা আজম এবং তাপস বিদ্রোহীদের একটি ডেলিগেশন নিয়ে যমুনায় আসছেন এবং তারা (বিদ্রোহীরা) চাচ্ছে সাধারণ ক্ষমা। সাবেক প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা) বলেন, বিদ্রোহীদের কিছু বলার থাকলে আমরা (তিন বাহিনীর প্রধান) যেন তাদের বলি।

মইন ইউ আহমেদ বলেন, ‘তখন আমি তাঁকে (শেখ হাসিনা) বলি, “অপারেশন রিস্টোর অর্ডার শুরুতেই আমাদের একজন সৈনিককে নিহত হতে হয়েছে এবং একজন গুরুতর আহত হয়েছে। এইমাত্র খবর পেলাম বিদ্রোহীরা অনেক অফিসারকে হত্যা করেছে। আমি আরো বলি, বিদ্রোহীদের কোন শর্ত মানা যাবে না। আপনি তাদেরকে বলবেন, অফিসার হত্যা এই মুহূর্তে বন্ধ করতে হবে। আর একটি প্রাণও যেন না হারায়। দ্বিতীয়ত, আটককৃত সকল অফিসার এবং তাদের পরিবারকে এক্ষুণি মুক্তি দিতে হবে। তৃতীয়ত, অস্ত্র এবং গোলাবারুদসহ সকল বিদ্রোহীকে আত্মসমর্পণ করতে হবে। চতুর্থত, আমি জোর দিয়ে বলি যে, সাধারণ ক্ষমা দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।’ আমাদের সাথে কথা বলার পরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী চলে গেলেন। আর এরইমধ্যে কিছু সময় আমরা পেলাম বিদ্রেহীদের সাথে আলোচনার আগে।

বিকেল ৩টা ৪৮ মিনিটে ডিএডি তৌহিদের নেতৃত্বে ১৪জন বিদ্রোহী আলোচনার জন্য যমুনায় প্রবেশ করে। তাদেরকে একটি বড়রুমে রাখা হয়। আমি আমার এডিসিকে বললাম, দেখোতো এদের মধ্যে নেতা কে, ডেকে নিয়ে এসো। এডিসি জুনায়েদ তৌহিদকে নিয়ে আসলো এবং আমি তাকে বললাম, আপনি আমাকে চেনেন। তিনি বললেন হ্যাঁ। তাকে কাছে সবিস্তারে জানতে চাইলাম কতজনকে হত্যা করা হয়েছে, এখন কী অবস্থা। তিনি (আমাকে) বললেন যে, সকাল ৯টায় বিদ্রোহীরা তাকে একটি কক্ষে তালা মেরে রেখেছিল। এখোন তালা খুলে আমাকে এখানে এনেছে। আমি কিছুই জানি না। এসময় আমি তাকে বলি যে, আপনার সাথে যারা এসেছেন তাদের কাছে জেনে আমাকে জানান। তিনি ভেতরে চলে গেলেন, আর আসেননি বাইরে। আধা ঘন্টার মত অপেক্ষা করে আবার কাপ্টেন জুনায়েদকে ভেতরে পাঠালাম ডিএডি তৌহিদকে ডেকে নিয়ে আসার জন্যে। সে ডেকে আনলো। তৌহিদকে আমি জিজ্ঞেস করলাম যে, আপনি তো উত্তর দিলেন না। বললেন, সাথে যারা এসেছে তারা সবজানে কিন্তু কেউউ মুখ খুলছে না। তৌহিদ আবার কনফারেন্স রুমে চলে গেল।

শেখ হাসিনা বিদ্রোহীদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন বলে উল্লেখ করে মইন ইউ আহমেদ বলেন, বৈঠকে শেখ ফজলে নূর তাপস, জাহাঙ্গীর কবির নানক ও মির্জা আজম ছিলেন। প্রথম পর্যায়ে আলোচনা তাঁর (মইন) জানা নেই। পরের পর্যায়ে শুধু আমাকে ভেতরে ডাকা হয়। সেখানে গিয়ে দেখি ঐ ১৪ জনকে। দেখলে মনে হয় যে সকলেই রাস্তার বখাটে ছেলে। তাদের ডিমান্ড কী ছিল তা আমি জানিনি। প্রধানমন্ত্রীকে হয়তো জানিয়েছেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বললেন, যেটি আমি শুনেছি যে, তোমরা অস্ত্র-গোলাবরুদ সারেন্ডার করো এবং সবাই ব্যারাকে চলে যাও। পরে উনি (প্রধানমন্ত্রী) সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেন। আলোচনা শেষে জনাব নানক অপেক্ষমান সাংবাদিকদের জানালো পরিস্থিতির সারাংশ এবং এটাও বললেন যে, প্রধানমন্ত্রী এই বিদ্রোহীদেরকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন। এবং তারা বলেছে এখোন আত্মসমর্পণ করবে এবং ব্যারাকে ফিরে যাবে। বিদ্রোহীরা ৬টা ৩৭ মিনিটে যমুনা থেকে পিলখানার উদ্দেশে রওনা দেয়। সেখানে গিয়ে তারা ঘোষণা দেয় যে, যতক্ষণ পর্যন্ত সাধারণ ক্ষমার প্রজ্ঞাপন তাদের হাতে না আসবে ততক্ষণ পর্যন্ত তারা আত্মসমর্পণ করবে না। তারা পুনরায় গোলাগুলি শুরু করে এবং অফিসারদের খুঁজতে থাকে।

মইন ইউ আহমেদ বলেন, রাত ১২টায় তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, শেখ ফজলে নূর তাপস ও তৎকালীন আইজিপি (পুলিশের মহাপরিদর্শক) পিলখানায় যান আলোচনার জন্য এবং তাদের সাথে বসেন। একপর্যায়ে বিদ্রোহীরা কিছু অস্ত্র সমর্পণ করে এবং আটটি পরিবারকে মুক্তি দেয়। এরমধ্যে শুধু তিনটি পরিবার ছিল সেনা অফিসারদের। ৫টি ছিল ডিএডি ফ্যামিলি। সাহারা খাতুন জানতেন অফিসার এবং পরিবারের সদস্যদেরকে কোয়ার্টার গার্ডে বন্দী করে রাখা হয়েছে। কিন্তু তিনি তাঁদের মুক্তির ব্যাপারে উদ্যোগ নেননি, খোঁজ-খবরও নেননি। ঐ ৮টি পরিবার নিয়ে তিনি পিলখানা থেকে বের হয়ে আসেন।

পরদিন ২৬ ফেব্রুয়ারি আবার গোলাগুলি শুরু করে বিদ্রোহীরা। সাবেক প্রধানমন্ত্রী সকাল সাড়ে ১০টায় তাঁকে ডেকে নেন জানিয়ে মইন ইউ আহমেদ বলেন, তাঁকে জানানো হয় বিদ্রোহীরা আত্মসমর্পণ না করলে সামরিক অভিযান পরিচালনা করা হবে। তিনি সাভার থেকে ট্যাংক আনার অনুমতি চান। সেটা দেওয়া হয়। তিনি ট্যাংক রওনা দেওয়ার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে নির্দেশ দেন। অন্য প্রস্তুতিও নেওয়া হয়। মইন ইউ আহমেদ বলেন, সেনাবাহিনীর প্রস্তুতি ও ট্যাংক আসার কথা শুনে বিদ্রোহীরা কোনো শর্ত ছাড়া আত্মসমর্পণে রাজি হয়। শেখ হাসিনা বেলা দুইটায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে বিদ্রোহীদের আত্মসমর্পণের সময়সীমা বেঁধে দেন। সেই পরামর্শ তিনি (মইন) দিয়েছিলেন। সেনাবাহিনীর আক্রমণ প্রস্তুতি দেখে বিদ্রোহীরা আলোচনা ও আত্মসমর্পণের জন্য উদ্গ্রীব হয় এবং সাদা পতাকা টানিয়ে দেয়। রাতে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি দল পিলখানায় প্রবেশ করে এবং বিদ্রোহীরা আত্মসমর্পণ করে। এর মাধ্যমে ৩৩ ঘণ্টার বিদ্রোহের অবসান হয়। প্রাণ হারান ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা, যাঁরা সেনাবাহিনীর মেরুদন্ড ছিলেন।

Facebook Comments Box

Posted ৫:৪৫ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪

nyvoice24 |

Address
New York
Phone: 929-799-2884
Email: nyvoice24@gmail.com
Follow Us